চলছে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা। —নিজস্ব চিত্র।
দরজায় কড়া নড়ল। গৃহস্থ দরজা খুলে আগন্তুকদের দেখে বললেন, ‘‘ওহ্, আপনারা! সময় হয়ে গিয়েছে, না?’’ উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি ঢুকে গেলেন ভিতরে। ফিরলেন কিছু টাকা হাতে নিয়ে। সেই টাকা নিয়ে পরের বাড়ির দিকে এগোলেন আগন্তুকেরা। সেখানেও কম-বেশি একই অভিজ্ঞতা।
এ ভাবেই তিলে তিলে সঞ্চিত হচ্ছে অর্থ। তার পর সেই টাকাতেই বসছে মেডিক্যাল ক্যাম্প। ক্যানসার নির্ণয় হচ্ছে। ক্যানসার রোগীরা কেমোথেরাপি পাচ্ছেন। মুমূর্ষু রোগীরা পাচ্ছেন কিছুটা উপশমের আশ্বাস। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুষ্টিভিক্ষা নিয়েই ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলায়।
ঠিক এ ভাবে মুষ্টিভিক্ষা করেই এর আগে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁউসি গ্রামে একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন বলরাম করণ ও ছবি করণ নামে এক দম্পতি। সেই আশ্রমে ঠাঁই পেয়ে জীবনটাই বদলে গিয়েছে বেশ কিছু শিশুর। এখনও চলছে তাকে ঘিরে ‘সমবেত’ প্রচেষ্টা। অনেকটা সেই ধাঁচেই মুর্শিদাবাদে গত তিন বছর ধরে শুরু হয়েছে ক্যানসার চিকিৎসা। জেলা স্তরে সরকারি বা বেসরকারি— কোনও ক্ষেত্রেই ক্যানসার চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা— গোটা পর্বটাই জেলার মানুষকে কলকাতার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হয়। বাড়িঘর ছেড়ে শহরে এসে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য থাকে না অধিকাংশেরই। কার্যত বিনা চিকিৎসাতেই মারা যান অনেকে। আশপাশে এমন অনেক মৃত্যু দেখে কিছু একটা করার কথা মাথায় এসেছিল বহরমপুরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। কাজে নেমে সেই সংস্থার সদস্যরা বুঝতে পারেন, সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এমন ভয়াবহ রোগের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তখনই জেলা জুড়ে মুষ্টিভিক্ষার কথা মাথায় আসে তাঁদের।
কিন্তু যাঁদের পরিবারে কোনও ক্যানসার রোগী নেই, কিংবা যাঁরা ওই পরিষেবা নিচ্ছেন না, তাঁরা কেন সাহায্য করছেন? সংস্থার তরফে কাঞ্চন মৈত্র বলেন, ‘‘সমস্যাটা সকলেরই এমন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে যে, কেউই জোর দিয়ে বলতে পারবেন না তিনি নিরাপদ। আমরা গোড়ার দিকে সেটাই বুঝিয়েছি সকলকে। ক্রমশ কাজটা সহজ হয়েছে। মানুষ এখন নিজে থেকেই এগিয়ে আসছেন। কলকাতার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেশ কিছু ডাক্তারও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের কাছে এটা এখন একটা আন্দোলন।’’
আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা সক্রিয় ভাবে যুক্ত তাঁদের কেউ সরকারি চাকরি করেন, কেউ বেসরকারি, কারও বা ব্যবসা রয়েছে। কিন্তু তাপস ঘোষ, অপূর্ব ভট্টাচার্য, নীলেন্দু সাহার মতো ওই সংগঠনের অনেক সদস্যই নিজেদের উপার্জন থেকে প্রতি মাসেই একটা অংশ এই কাজে ‘লেভি’ দেন। তাঁদের কথায়, ‘‘এটা আমাদের বিবেকের লেভি।’’
একেবারে গরিব রোগীদের নিখরচায় পরিষেবা দেওয়া হয়। আর যাঁরা তুলনায় স্বচ্ছল, তাঁদের জন্য রয়েছে কম খরচে চিকিৎসার সুযোগ। শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান, এমন কী বাংলাদেশ থেকেও রোগীরা আসছেন।
এই প্রকল্পের সঙ্গে গোড়া থেকেই যুক্ত আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এই কাজটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একটা ক্লাবের কিছু সদস্য অপরিসীম চেষ্টায় তিল তিল করে সব কিছু করছেন। কত ক্লাব বছরের নানা সময়ে বিভিন্ন উৎসব খাতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। সেই টাকা থেকে অন্তত কিছুটা যদি এই মানুষদের জন্য খরচ করা হতো, তা হলে অনেক ক্যানসার রোগী সময় মতো কেমোথেরাপি পেতেন। রেডিয়েশন নেওয়ার জন্য তাঁদের অনন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।’’
কেন আরও বেশি করে কলকাতার চিকিৎসকদের এই কাজে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন না তাঁরা? সংস্থার এক সদস্য বলেন, ‘‘এখন আমরা অনেক বেশি সাবধানী। কলকাতার অনেক ডাক্তারই এখানে নিখরচায় রোগী দেখতে এসে পরবর্তী চিকিৎসা কলকাতায় তাঁদের কাছে করানোর ব্যাপারটা নিশ্চিত করে যেতেন। ক্রমে আমার বুঝতে পারলাম, এ ভাবে চলতে থাকলে আমরা ক্রমশ ওই ডাক্তারদের রোগী ধরার দালালে পরিণত হব। এখন তাই অনেক সতর্ক হয়ে আগে থেকে খোঁজখবর করে তার পরে যোগাযোগ করি।’’
ইতিমধ্যেই কলকাতার একটি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে ওই সংস্থার প্রয়াসকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রের তরফে ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে সরকারের পাশাপাশি এই ধরনের সংগঠন এগিয়ে না এলে রোগটার মোকাবিলা করা অসম্ভব।’’
কেউ যে এগিয়ে আসছেন না, তা-ও অবশ্য নয়। বেহালার ক্যানসার আক্রান্ত এক গৃহবধূ রমা মজুমদার তাঁর নিজের জমানো টাকা দিয়ে ক্যানসার রোগীদের ওষুধ জোগানোর কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের মার্চে স্তনে ক্যানসার ধরা পড়েছিল তাঁর। তার পর থেকে নিঃশব্দে ক্যানসার রোগীদের জন্যই কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। সম্প্রতি রমাদেবীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর শুরু করা কাজ এ বার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর স্বামী রমেশ মজুমদার। খড়দহের বাসিন্দা সুকান্ত চৌধুরীর মলদ্বারে ক্যানসার হয়েছিল। মৃত্যুর আগে প্রিয়জনদের বলে গিয়েছিলেন, তাঁর জমানো টাকা দিয়ে যেন ক্যানসার রোগীদের জন্য কোনও প্রকল্প শুরু করা হয়। সেই প্রকল্প এখন পরিষেবা দিয়ে চলেছে বহু দুঃস্থ রোগীকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি ঘরে এক জন ক্যানসার রোগী মিলবে। শত্রু যখন এমন শক্তিশালী, তখন প্রতিপক্ষকেও শক্তিশালী হতে হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। এমন অনেক বাড়ানো হাত সেই শক্তিই আরও খানিকটা বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে অনেকেরই অভিমত।
মুর্শিদাবাদ সেই দিশাই দেখাচ্ছে।