প্রতীকী ছবি।
কারও চোখ ফুলে লাল হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত জল ঝরছে। কারও চোখের পাতা বুজে আসছে ওই লাল ফোলার সঙ্গেই। কেউ আবার সর্বক্ষণ ঝাপসা দেখতে শুরু করেছেন! দৃষ্টিশক্তি হারানোর উদাহরণও কম নেই! কোভিড থেকে সেরে উঠলেও এমনই চোখের জটিলতায় ভুগছেন অনেকেই। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শুধু কোভিড থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিরাই নন, বাড়িতে থাকার এবং কাজের অভ্যাসে বদল ঘটায় এই মুহূর্তে চোখ নিয়ে জেরবার হচ্ছেন কমবেশি সকলেই।
যাদবপুরের সুকমল সরকার কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন গত ডিসেম্বরের শুরুতে। সেরে ওঠার দিন পনেরোর মধ্যেই তাঁর বাঁ চোখ লাল হতে শুরু করে। চোখ ফুলে গিয়ে জল গড়াতে দেখে এর পরে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন তিনি। প্রথমে কনজাংটিভাইটিস হয়েছে বলে মনে হলেও পরে চিকিৎসক নিশ্চিত হন, সেটি কোভিডেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। পরের দিন দশেক আবছা দেখার পরে এখন ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে তিনি। সুকমল বললেন, ‘‘এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, অস্বস্তি হচ্ছে। সে দিনই সন্ধ্যার পরে চোখ ফুলে গিয়েছে। লাল হয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ ঝাপসা দেখতে শুরু করেছিলাম। এক সময়ে মনে হয়েছিল, হয়তো আর কোনও দিন দেখতেই পাব না।’’
লেক টেম্পল রোডের আর এক বাসিন্দা সুনীতা দত্তগুপ্তের দাবি, ‘‘কোভিড নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার এক সপ্তাহ পরে দেখি, চোখে দেখতেই পাচ্ছি না। যেমন দূরের, তেমনই কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা হচ্ছে। আগে চশমা ছিল না। চিকিৎসককে দেখিয়ে চশমা তো নিতে হলই, সেই সঙ্গে তিনি জানালেন, রেটিনায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে।’’
চোখের চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরে এমন বহু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবেরই ব্যাখ্যা পরিষ্কার নয়। ফলে কনজাংটিভাইটিস হয়েছে ধরে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। পরীক্ষার পরে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে অপটিক নিউরোপ্যাথির দিকেও চলে যাচ্ছে বিষয়টি। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই সতর্ক না হলে রোগীর দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে। এমন উদাহরণও সামনে এসেছে যে, নেশাগ্রস্ত এক ব্যক্তি স্যানিটাইজ়ার খেয়ে ফেলায় দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়েছেন’’
চক্ষু চিকিৎসক জ্যোতির্ময় দত্ত আবার বললেন, ‘‘করোনার পরে অন্তত পাঁচ-দশ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস পাচ্ছি আমরা। চোখের জলের মধ্যে তিন সপ্তাহ করোনাভাইরাস বাঁচতে পারে। ফলে সতর্ক হওয়া খুব জরুরি।’’
চিকিৎসকেরা জানান, শুধু করোনা রোগী নন, প্রতি দশ জনের মধ্যে আট জনেরই এখন চোখের সমস্যা। অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন। অফিস আর বাড়ির পরিবেশের মধ্যে আলোর পার্থক্য হচ্ছে। তা ছাড়া, অফিসের ডেস্কটপের বদলে বাড়িতে অনেকেই হয় ল্যাপটপ বা মোবাইলে কাজ সেরে নিতে চাইছেন। ডেস্কটপের চেয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিন ছোট, মোবাইল তো আরও ছোট! যত ছোট স্ক্রিনে কাজ করা হবে, চোখের উপরে চাপ ততই বেশি পড়বে। ল্যাপটপ বা মোবাইল হাতে আবার বেশির ভাগ মানুষই বসে কাজ করতে চান না। ফলে ‘ভিউয়িং অ্যাঙ্গেল’ বদলে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে বাড়ছে চোখের পাওয়ার। লকডাউনের আগে যা পাওয়ার ছিল, অনেকেরই এখন সেই পাওয়ার মিলছে না। শিশুদের অনলাইন ক্লাস আবার কাগজ পড়ার অভ্যাসই শেষ করে দিচ্ছে। সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকা কোনও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে কারও চোখ বাঁচে?
আর এক চক্ষু চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্তের দাবি, করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগী ‘ডিজিটাল আই স্ট্রেন’ কমাতে না পারার কারণেই নানা সমস্যা হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘‘চোখকে বিশ্রাম দেওয়ার কৌশল আমরা ভুলে যাচ্ছি। করোনার পরে চোখে কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেলে সমস্যা কম হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে না।’’
চিকিৎসকদের বক্তব্য, করোনার সময়ে রোগীকে এমনিতেই বিশ্রামে থাকতে হয়। কিন্তু বাড়িতে বা হাসপাতালের সেই বিশ্রাম মোবাইল-হীন হয় না। ফলে শরীর বিশ্রাম পেলেও চোখ ছোট পর্দায় নাগাড়ে কাজ চালিয়ে যায়। চোখের শুষ্কতা বেড়ে যাওয়ায় ভাইরাস সহজেই পথ পেয়ে যায়।
তা হলে উপায়? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নির্দিষ্ট সময় অন্তর চোখকে বিশ্রাম দেওয়াই একমাত্র পথ। মোবাইলে বা কম্পিউটারে কাজ চালানোর সময়ে মনে করে চোখের পাতা ফেলার কথা মাথায় রাখতে হবে। তাতে চোখের শুষ্ক ভাব কমবে। শৌভিকবাবুর মন্তব্য, ‘‘স্বচ্ছ দেখছেন না বুঝলেই যন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখুন। করোনার পরেও এই একটাই মন্ত্র।’’