খেলোয়ারের শরীরে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। —শাটারস্টক
টোকিও অলিম্পিকের পর ৩৭ বছরের মেরি কম অবসর নেওয়ার কথা ভাবছেন। যদিও তিনি যথেষ্ট ফিট, তাও একটা বয়সের পর খেলার মাঠ থেকে সরে আসতে হয়, শরীরের বিশেষ যত্নও নিতে হয়। আসলে যাঁরা নিয়মিত খেলাধুলো করেন, তাঁরা সাধারণত চট করে অসুস্থ হন না। কেন না জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে খেলতে গেলে নিয়মিত এক্সারসাইজ ও খাবারের ব্যাপারে কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এখনকার কোভিড আবহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এই বিষয় দু’টির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু খেলোয়াড়দের ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। কঠোর দৈহিক পরিশ্রম করতে গিয়ে কখনও মেয়েদের শরীরের অন্দরের স্বাভাবিক ছন্দ ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। মাঠ থেকে অবসর নিয়ে যৌথ জীবনে গিয়ে সন্তান ধারনেও সমস্যা হতে পারে।
খেলতে গেলে এন্ডিওরেন্স ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। অ্যাথলেটিক্স, জিমন্যাস্টিক, লং জাম্প, হাই জাম্প, ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, শ্যুটিং, জিমন্যাস্টিক, রোয়িং, সাঁতার, ভারোত্তোলন বা কুস্তি সব খেলাতেই আজকাল মেয়েদের আগ্রহ বাড়ছে। আর এই সব খেলা খেলতে গেলে শরীর গড়তে হয় বিশেষ ভাবে। নিয়ম করে প্রত্যেক দিন ৩ চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় অনুশীলন করতেই হয়। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ পল্লব গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন যে, কঠোর এক্সারসাইজ (এক্সট্রিম ট্রেনিং) করলে তাঁদের পিটুইটারি ও হাইপোথ্যালামস গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। এর ফলে তাঁদের ঋতুচক্র সাময়িক ভাবে থেমে যেতে পারে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার আগে অতিরিক্ত অনুশীলন করলে পিটুইটারি হরমোন নিঃসরণ কমে গিয়ে সমস্যার সূত্রপাত হয়। তবে ব্যাপারটা সাময়িক। কম্পিটিশনের পরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋতুচক্র স্বাভাবিক হয়ে যায়, বললেন পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন : ডায়াবিটিসের দোসর করোনা! এই ওষুধে হতে পারে মারাত্মক ক্ষতি
শরীরে বেশি মেদ জমলে যেমন লাইফস্টাইল ডিজিজ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তেমনই শরীরে মেদ না থাকলেও সমস্যার ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় পিরিয়ডের দিন আর কম্পিটিশনের দিন একই সময় পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে গায়নোকলজিস্টকে দেখিয়ে লো ডোজ কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলস নিয়ে পিরিয়ডের সময়টা পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে বারে বারে এই পিছিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। কেন না স্পোর্স্টস ওম্যানদের এমনিতেই ঋতুচক্র স্বাভাবিক নিয়মে হয় না। তার উপর বারংবার পিছিয়ে দিলে শরীরে জলের ভাগ বেড়ে যায়, চলতি কথায় যাকে বলে জল জমা (ওয়াটার রিটেনশন)। এর ফলে খেলতে অসুবিধে হয়, বললেন পল্লব। মেয়েদের জন্যে ভাল খেলা সাঁতার। এতে শরীরের সে রকম কোনও অসুবিধে তো হয়ই না, বরং অনেক ফিট থাকা যায়। গায়নোকলজিক্যাল সমস্যাও হয় না, বললেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়। তবে পিরিয়ড চলাকালীন সাঁতার কাটতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার। এই অবস্থায় ট্যাম্পোন ব্যবহার করা সব থেকে ভাল। একটা কথা মনে রাখা দরকার, ৪ ঘণ্টার বেশি এই ট্যাম্পোন রাখা উচিত নয়। এর থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পিরিয়ড চলাকালীন ম্যারাথন হলেও মেয়েদের কিছুটা মুশকিলে পড়তে হয়। কেন না এই অবস্থায় ট্যাম্পোন ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার সম্ভব নয়। আর এর মেয়াদ মেরে কেটে সেই ৪ ঘণ্টাই। অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন যে, ইস্ট্রোজেন হরমোন মেয়েদের হাড়ের ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু কঠোর ভাবে এন্ডিওরেন্স ট্রেনিং করতে গিয়ে মাসিক ঋতুচক্রের ছন্দ বদলে যায়। অ্যামেনোরিয়া অর্থাৎ অনিয়মিত পিরিয়ডের পেছনে আছে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি। আর কম হরমোন মানেই হাড়ের ক্যালসিয়াম কমতে শুরু করা।
আরও পড়ুন : বদ্ধ ঘরে বসে কাজ, ব্যথা বেদনার পৌষমাস, কিন্তু বাঁচবেন কী করে?
সমীক্ষায় জানা গেছে যে, স্টেট লেভেলে খেলেন এই ধরনের মহিলা খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রায় ৫০%-এরই পিরিয়ড অনিয়মিত। অল্প বয়সে ইস্ট্রোজেনের অভাবে হাড়ের ঘনত্ব কমে যেতে শুরু করে। এ দিকে ডায়েটেও যে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকা উচিত, সে বিষয়েও তাঁরা সচেতন নন। এর নিট ফল, নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই এঁদের হাড়ের ক্যালসিয়াম কমে গিয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ যখন তখন হাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ছোট বয়সে খেলতে আসা মেয়েদের ভয়ানক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কম্পিটিশন থেকে ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা অনেক সময় খাবারের ব্যাপারে বিশেষ নজর দেন না। পারফরম্যান্স ভাল না হলে মনে করেন, কম খেয়ে ওজন কম রাখলে বোধ হয় ভাল খেলতে পারবেন। এইভাবে এঁরা ইটিং ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন। আর সঠিক পুষ্টির ঘাটতি হলে একদিকে সমস্যা উত্তোরত্তর বাড়তেই থাকে, বললেন অভিনিবেশ।
মা হওয়ার পরিকল্পনা করতে গিয়ে অনেক খেলোয়াড় নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্যে সন্তান ধারনের জন্য ইউটেরাস বা জরায়ুতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হতে পারে না। ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে ইউটেরাসে এন্ডোমেট্রিয়ামের লাইনিং তৈরি হয়। এখানেই ভ্রূণ বেড়ে ওঠে। আবার নিয়মিত ঋতুস্রাব না হলে ডিম্বাণু নিঃসরণেও অসুবিধে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ওষুধের সাহায্যে পিরিয়ড স্বাভাবিক ছন্দে আনা হয়। এর পর সন্তানের চেষ্টা সফল না হলে আর্টিফিসিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ টেকনিকের (এআরটি) সাহায্য নেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে আইভিএফ বা টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েও সন্তান ধারণ করা যায়। ৩০ বছর বয়সের মধ্যে মা হতে পারলে ভাল। তবে খেলোয়াড়রা সাধারণ মেয়েদের থেকে অনেক বেশি ফিট, তাই স্টেফি গ্রাফের মতো বেশি বয়সে মা হলেও খুব অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
আমার পড়ুন : সৌরভ: কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল
সেরেনা উইলিয়ামস, মেরি কম বা সানিয়া মির্জার মতো অনেকে সন্তানের জন্মের পরেও মাঠে ফিরতে চান। এ ক্ষেত্রে সন্তানের জন্মের ৬ মাসের মধ্যে খেলার মাঠে ফিরে যাওয়ার জন্যে অনুশীলন শুরু করা দরকার। অভিনিবেশ জানালেন, স্বাভাবিক ওজনের মেয়েরা যদি সপ্তাহে ৭ ঘণ্টার বেশি সময় অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করেন তবে ওভ্যুলেশনের সমস্যা হতে পারে। অ্যামেরিকান কলেজ অব স্পোর্টস মেডিসিনের বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিযোগিতার আগে হেভি এক্সারসাইজ করলেও অন্য সময় মডারেট এক্সারসাইজ করা উচিত। লাগাতার হেভি এক্সারসাইজ নানান সমস্যা ডেকে আনতে পারে। খেলাধুলোর পাশাপাশি দরকার সঠিক ডায়েটও, সেটা মনে রাখতে হবে।