Bengali Medium Schools

সম্পাদক সমীপেষু: শিক্ষায় অনাগ্রহ

বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরে যেতে শুরু করেছে সেই বাম আমলেই, যখন প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:০৩
Share:

বিশ্বজিৎ রায়ের‌ ‘এই আমরা চাই বুঝি?’ (১২-৪) শীর্ষক প্রবন্ধ পড়ে কয়েকটি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরে যেতে শুরু করেছে সেই বাম আমলেই, যখন প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হল। একদা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের পর পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করত অনেকে। অথবা শিক্ষকতা, ব্যাঙ্কের কেরানি বা রেলের চাকরি বেছে নিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়ে। আজ সে দিন নেই। সরকারি চাকরির পরিসর সঙ্কুচিত। আছে চুক্তিভিত্তিক চাকরি। গ্রামবাংলার মানুষের হাতে কাজ না থাকায়, পড়াশোনা ছেড়ে পশ্চিম কিংবা দক্ষিণ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে হাজার হাজার কিশোর, তরুণ।

Advertisement

অন্য দিকে, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির প্রাথমিক থেকে উচ্চ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বৃহদংশের ভাষা শিক্ষার সঙ্গে গণিত শিক্ষার মান নিম্নগামী। বাড়ি থেকে শিক্ষাঙ্গন— সব ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাবকেও অনেকে দায়ী বলে মনে করেন। টিউশনি-নির্ভর শিক্ষা প্রান্তিক পড়ুয়ার দিকে নজর দেয় না। পরিণামে স্কুলছুট। এটাও সত্যি যে, বাংলা মাধ্যম স্কুলে যে সিলেবাস, এখনও তার সঙ্গে কাজের জগতের যোগ নেই। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কাজ জোটে না। স্বভাবতই নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসার আগ্রহ হারাচ্ছে। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন কর্মোপযোগী সিলেবাস তৈরিতে সরকারের মনোযোগী হওয়া। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ন্যূনতম কাজ জোটাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে যে প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তার পরিসর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠনের মধ্যেই করে দিতে হবে। ভাষা ও গণিতের সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষার মেলবন্ধনের মাধ্যমে সিলেবাস তৈরি হলে এই বিপর্যয় ঠেকানো যেতে পারে।

প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪

Advertisement

অর্থকেন্দ্রিক

‘এই আমরা চাই বুঝি?’ প্রবন্ধটিতে এক গভীর পর্যবেক্ষণ নিহিত রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থকেন্দ্রিক বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার ঘটছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা এই সব বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নিতে পারছে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির অভিভাবকদের আর্থিক টানাপড়েনেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে পড়াতে। পর্যাপ্ত বিষয়-শিক্ষক, পরিকাঠামোর অভাবে সরকারি স্কুলগুলি কার্যত ধুঁকছে।

যে-হেতু এই রাজ্যে সাধারণ ও নিম্ন মেধার ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার শেষে নিশ্চিত কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ নেই, সে-হেতু পড়াশোনার প্রতি তারা আগ্ৰহ হারাচ্ছে এবং পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা কাটাতে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি থেকেই স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের অধিকাংশই ভিন রাজ্যে নানা ধরনের কাজে চলে গিয়েছে, এবং ছাত্রীদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে গ্ৰামীণ অর্থনীতি অনেকাংশে সচল রয়েছে মূলত এই পরিযায়ী শ্রমিকদের রোজগারের উপর। এ দিকে নাবালিকা ছাত্রীরা বিয়ের পর মাঠের কাজ কিংবা পরিচারিকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই অপরিণত বয়সে শ্রমের চাপে খুব তাড়াতাড়ি স্বাস্থ্যহানি ঘটছে ওদের। নাবালিকা মায়েরা অধিকাংশই রক্তাল্পতায় ভুগছে।

এখনকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী একটি বিষয় নিজের ভাষায় গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। এই ভাষাগত দুর্বলতার জন্যই অন্যান্য বিষয় দুর্বোধ্য ঠেকে। চ্যাটজিপিটি-র দৌলতে গড়পড়তা লেখনীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু দক্ষ-সমৃদ্ধ হতে গেলে রচনায় নিজস্বতার অনুশীলন প্রয়োজন। এই সঙ্কট মোচনে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন, প্রয়োজন শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যাচর্চার আনন্দময় পরিবেশ। এ বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের উদ্যোগ জরুরি।

শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর

দুর্দশাগ্রস্ত

রাজ্য সরকারের শিক্ষক নিয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির দায়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষক-সহ যে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গেল, তার আগেও স্কুলগুলিতে পঠনপাঠন কেমন অবস্থায় ছিল? সরকারপোষিত স্কুলে রাজ্যের গরিষ্ঠ সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়ে। এরা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র পরিবার থেকে আসে, যেমনটি এত বছর ধরে হয়ে এসেছে। শিক্ষার মান ভাল থাকাতে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকেও বহু শিক্ষিত ছাত্রছাত্রী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু এখন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বছর কমে আসছে। কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের যে বিষয়গুলিতে আসনের জন্য প্রতিযোগিতা হত, এখন সেখানে ভর্তির জন্য ছাত্র পাওয়া যায় না। ক্লাস এইট পর্যন্ত এরা ভাল করে ভাষা শিক্ষা, অঙ্ক, কিছুই শেখে না। স্কুলে পড়াশোনা বজায় রাখতে অনেক সময় স্কুল ফান্ড থেকে অল্প টাকা দিয়ে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। স্বাধীনতার পরে স্কুলশিক্ষার এত খারাপ অবস্থা কখনও হয়নি। ছাত্রছাত্রীরা সাইকেল, ট্যাব যা পাচ্ছে, নিয়ে স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। তা হলে শিক্ষা যে চেতনা আনে, শিক্ষা যে জাতির মেরুদণ্ড, তা কি এমন ভাবে ধসে যাবে? যথার্থই বলা হয়, একটা জাতিকে শেষ করতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করাই যথেষ্ট।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনা

বেলাগাম দুর্নীতি

২৫,৭৫৩ জনের চাকরি শীর্ষ আদালতের রায়ে বাতিল ঘোষণায় পর সংবাদ শিরোনামে ‘দুর্নীতিরাজ’ (৪-৪) একটি নতুন শব্দবন্ধনী। এই দুর্নীতি দলে গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং এর উদ্দেশ্য আইন-বহির্ভূত অর্থ উপার্জন, যা শাসক দলের তহবিলের কলেবর বৃদ্ধি করে। ফলে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী, এমনকি শীর্ষ নেতৃত্বকেও দুর্নীতিতে প্রশ্রয় দিতে হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে, এটা যদি প্রমাণ হয়েই থাকে, তা হলে এই দুর্নীতিতে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সিবিআই এখনও চিহ্নিত করতে পারল না কেন? দু’বছর ব্যাপী তদন্তে তা হলে কি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষকদের চাকরি বাতিল করা? শিবরাম চক্রবর্তীর ‘জোড়াভরতের জীবন কাহিনী’তে দুই ভাই জোড়া শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এক শরীরেই সৎ এবং অসৎ বুদ্ধির আলাদা দু’টি মাথা। স্বভাবতই দুই মাথার মধ্যে অহর্নিশ মতের অমিল, এবং প্রতি দিনই সংঘাত। গল্পের শেষে সৎ মাথার ভাইকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে অসৎ মাথার ভাই অতিরিক্ত আফিম সেবন করে আত্মহত্যা করে। সৎ মাথার ভাইও মারা পড়ে। দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের পরিস্থিতিতে এটিই উপযুক্ত গল্প।

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার দাপট ও দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য— পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া প্রায় অসম্ভব। এই সহযোগিতা শীর্ষ নেতৃত্বের অজানতে হয় না। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা থেকে শিক্ষা, খাদ্য, আবাস যোজনা— সমস্ত ক্ষেত্রে বেলাগাম দুর্নীতি হয়েছে জানা সত্ত্বেও দলের শীর্ষে যিনি সততার প্রতীক, তাঁকে এই দুর্নীতির সপক্ষে বিভিন্ন রাজ্যের দুর্নীতির উদাহরণ খুঁজতে হচ্ছে। এখন দেখার, এ রাজ্যে কোন মাথাটির প্রভাব রাজ্যবাসীর উপর বর্তায়।

পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement