বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া মর্জিমাফিক যোগাসন করা একেবারেই উচিত নয়। প্রতীকী ছবি।
বেশ কিছু দিন ধরে পিঠে একটা ব্যথা ভোগাচ্ছে পর্ণাকে। এ দিকে, ডায়েট-চার্ট মেনে খাওয়ার পাশাপাশি দিনে দু’বার যোগাসন করে সে। তা-ও পিঠে ব্যথা শুরু হওয়ায় মনটা খানিক খারাপই হল তার। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কিন্তু বুঝল, এই ব্যথা শুরুর পিছনে দায় তারই। অতিরিক্ত যোগাসন ডেকে এনেছে এই বিপত্তি।
আধুনিক জীবনযাত্রায় যোগাসন এখন পরম আদরের। ইঁদুর দৌড়ের স্ট্রেস বা শরীরের ব্যথা-বেদনা সব কিছুর ওয়ান স্টপ সলিউশন যোগাসনকেই মানেন অনেকে। তবে, কখনও সেই যোগাসনের সুঅভ্যাস মাত্রাতিরিক্ত হলে ঘনিয়ে আসতে পারে সঙ্কট। বিশেষ করে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া মর্জিমাফিক যোগাসন করা একেবারেই উচিত নয়। ছোট ছোট ভুলেই শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। যোগশিক্ষক তাপস মণ্ডল জানালেন, অতিরিক্ত বা ভুল ভাবে করা যোগাসনে শারীরিক ক্ষতি অবশ্যই হয়। দীর্ঘ ৪০ বছরের পর্যবেক্ষণে তিনি দেখেছেন, অতিরিক্ত যোগাসন করার ফলে অনেক সময়েই লিগামেন্ট ও টেন্ডন ছিঁড়ে যায়। পেশির ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। চলে আসে অকালবার্ধক্য।
অতিরিক্ত যোগাসন করার প্রবণতা কেন আসে মানুষের?
তাপস জানালেন, যোগাসন করতে করতে মানুষ যখন অনুভব করেন তিনি ক্রমশ সুন্দর ও নীরোগ হয়ে উঠছেন, তখন সেটা বেশি করার প্রবণতা দেখা যায়। এক দিনে হয়তো বোঝা যায় না এর ফলে কী ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ দিন পরে মালুম হয়। আসলে, প্রতিটি আসন করার নির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। নিজের ভালর জন্য সেই সীমারেখা লঙ্ঘন না করাই ভাল।
এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, “আসন প্রতিযোগিতায় একটি আসন নিখুঁত ভাবে বারবার করতে হয়। সেখানে সময়টাও বড় বিষয়। এমনই এক প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা পাওয়ার জন্য এক প্রতিযোগী এমন ভাবে একপদশিরা আসন করেন, যে বেকায়দায় তাঁর কোমরের হাড় সরে যায়। গুরুতর ভাবে জখম হন ওই প্রতিযোগী। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকের পরামর্শের।” নিয়মিত যাঁরা বেশি করে ডিম্বাসন করেন, তাঁদের লাম্বাগো স্পন্ডিলাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া অ্যাঙ্কাইলোসিস স্পন্ডিলাইটিস বা মেরুদণ্ড কাঠের মতো শক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
বলা চলে, মাত্রাতিরিক্ত যোগাসন করার আসক্তির পিছনে মানসিক দিকও কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম হল সব সময়ে নিখুঁত ভাবে কাজ করার তাগিদ ও নিজের লক্ষ্য উঁচু তারে বেঁধে এগিয়ে চলার প্রবণতা। এর সঙ্গে অনেক সময়েই কাজ করে মোটা হওয়ার ভয়, খানিক হীনম্মন্যতা, কোনও অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। এর যে কোনও একটি বা একাধিক বিষয়ের বশবর্তী হয়ে যদি অতিরিক্ত আসনের ফাঁদে পা দেন কেউ, পেশির সূক্ষ্ম তন্তু, তরুণাস্থি ও লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারও কোমরে চোট ও হাঁপানি থাকলে তা আরও বেড়ে যায়।
ছোট ছোট ভুলেই শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। প্রতীকী ছবি।
যোগাসন করার ঠিক নিয়ম
তাপস জানালেন, যোগাসনের প্রাথমিক ও গঠনগত পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। এই পাঁচটি দিক মেনে আসন করলে শরীর সুস্থ থাকে। এগুলি হল ফরওয়ার্ড বেন্ড অ্যান্ড ব্যাক বেন্ড, ল্যাটারাল বেন্ড, টুইস্ট অ্যান্ড ব্যালান্স। এই পাঁচ রকমের আসন নিয়মিত করলে সুস্থ থাকা যায়। আবার এগুলোর সহজ থেকে কঠিন নানা পর্যায় রয়েছে। নিজের ক্ষমতা অনুসারে পর্যায়ভিত্তিক আসন বেছে নেওয়া প্রয়োজন এবং তা অবশ্যই যোগশিক্ষক বা যোগশিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলে। অবশ্যই শুরু করা উচিত সহজ আসন দিয়ে, জানুশিরাসন দিয়ে শুরু করেই পরের দিন টিট্টিভাসন করার চেষ্টা ক্ষতিকর। আর যাঁরা যোগাসন শুরু করছেন, প্রাথমিক ভাবে দশ সেকেন্ডের বেশি এক একটা আসন করা একেবারেই উচিত নয়।
তাপস আরও জানালেন, অনেকে বই বা ইউটিউব দেখে আসন করেন। এটা একেবারেই ঠিক পদ্ধতি নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক পদ্ধতি লেখা থাকে না সেখানে। আবার, কাদের কোন কোন আসন করা নিষেধ সেই সংক্রান্ত তথ্যও ঠিক ভাবে থাকে না অনেক সময়ে। ফলে, বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেই কারণেই প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষকের, যিনি লেখাপড়া করেছেন বিষয়টি নিয়ে, ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা রয়েছে।
দিনে এক বার ঠিক ভাবে যোগাসন প্রয়োজন। রোজ ৩০-৪০ মিনিট আসন অভ্যাস করলেই যথেষ্ট। দিনে ৫০ বার বা তিন ঘণ্টা ধরে আসন অভ্যাস যেমন ক্ষতিকর, তেমনই হঠাৎ তা বন্ধ করে দিলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই, ভারসাম্য রেখে যোগাসন করা প্রয়োজন। আসন অভ্যাস নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য। আসন অভ্যাসে ধৈর্য বাড়ে, স্থিতধী হন মানুষ। এটি নিজের বা অন্য কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নয়।