Facial Hair

মুখে অতিরিক্ত রোম, রোগের লক্ষণ নয় তো!

শরীরে অতিরিক্ত রোমের আধিক্যকে বলে হারসুটিজ়ম। এর প্রভাবে মেয়েদের ফেশিয়াল হেয়ার বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। শারীরিক ও মানসিক ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন কী ভাবে?

Advertisement

শ্রেয়া ঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ০৭:২৬
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সৌন্দর্যের জয় সর্বত্র, এই আপ্তবাক্যকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে মনে করেন বহু মানুষ! সমাজে স্বীকৃত সৌন্দর্যের ছাঁচে ফেলতে ব্যস্তও হয়ে পড়েন অনেকে। প্রতিষ্ঠিত সৌন্দর্যের ধারণার কাছে মাঝেমাঝে ম্লান হয়ে যায় মেধা, গুণ ও কৃতিত্ব। যেমন উত্তরপ্রদেশের প্রাচী নিগম... দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ৯৮.৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছে সে। কিন্তু সেই কৃতিত্ব ছাপিয়ে চর্চা চলছে তাঁর মুখের অতিরিক্ত রোম নিয়ে। মেধা নয়, বরং সমাজমাধ্যমের ‘বিচারকেরা’ নেমেছেন তার রূপের বিচার করতে।

Advertisement

মেয়েদের ফেশিয়াল হেয়ার বেশি হলেই তা অনেকের ভ্রুকুটির কারণ হয়। অথচ, এর পিছনে রয়েছে কিছু শারীরিক সমস্যা। যেমন হরমোনঘটিত সমস্যা, জিনগত বৈশিষ্ট্য। নারীশরীরে অতিরিক্ত রোমের আধিক্যকে বলা হয় হারসুটিজ়ম। এতে চিবুক, ঠোঁটের উপরের অংশে, গালের পাশে, পিঠ, বুক ইত্যাদি স্থানে অতিরিক্ত ঘন রোম গজাতে শুরু করে। মূলত পুরুষ হরমোন তথা অ্যান্ড্রোজেনের আধিক্যের ফলেই এমনটা ঘটে। কোনও কোনও গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায় হারসুটিজ়ম।

এই প্রসঙ্গে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, “জিনগত বা বংশগত কারণে এই অবস্থার সূচনা হতে পারে। এ ছাড়া পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, কুশিং সিনড্রোম, এমনকি ওবেসিটির জন্যও দেখা যেতে পারে হারসুটিজ়ম। এটি একেবারেই অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কখনও কখনও কোনও ওষুধের প্রভাবেও এমনটা হতে পারে।”

Advertisement

অর্থাৎ অসুখের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা দিতে পারে এই অবাঞ্ছিত রোম। তা নিয়ে কটাক্ষ সমীচীন কি? বাক্‌স্বাধীনতার অপব্যবহার বড় বেদনাদায়ক কোনও কোনও ক্ষেত্রে।

কী কী কারণে হতে পারে হারসুটিজ়ম?

  • পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম: পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজ়িজ় (পিসিওডি)— দু’টি ক্ষেত্রেই শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। ফলে, অ্যান্ড্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দেখা দেয় অতিরিক্ত রোম।
  • কুশিং সিনড্রোম: অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অতিরিক্ত কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ করতে শুরু করলে হারসুটিজ়ম দেখা যায়।
  • কনজেনিটাল অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া: অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় কর্টিসল ও অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিঃসরণ। অনেক সময়ে টিউমরের ফলেও এটা হয়।
  • ওষুধের প্রভাব ও ওবেসিটি: নিয়মিত কোনও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হারসুটিজ়ম দেখা যায়। এ ছাড়া, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির ফলেও অনেক সময়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
  • জন্মগত: কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি জিনগত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে কোনও কারণ ছাড়াও এই অবস্থা দেখা যায়।

হারসুটিজ়ম কমানোর উপায়?

চন্দ্রিমা বললেন, “কোনও অসুখের কারণে হারসুটিজ়ম দেখা গেলে অবশ্যই তার চিকিৎসা করা প্রয়োজন। আর গজিয়ে ওঠা রোম নির্মূল করতে শেভিং, ওয়্যাক্সিং, এপিলেটিং, প্লাকিং, ব্লিচিং পদ্ধতির ব্যবহারও করা যেতে পারে। তবে এগুলো অস্থায়ী পদ্ধতি। স্থায়ী ভাবে রোম থেকে মুক্তি পেতে হলে লেজ়ার বা ইলেকট্রোলাইসিস পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া মুখে খাওয়ার কিছু হরমোনাল ওষুধ ও টপিকাল ক্রিমেও কাজ হয় অনেক সময়ে, তবে এগুলো অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ব্যবহার করতে হবে।” প্রসঙ্গত, ‌দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত যে শেভ করলে মেয়েদের ‘দাড়ি’ আরও বেড়ে যায়। চন্দ্রিমা জানালেন, এটি সম্পূর্ণ ভুল কথা।

কিন্তু মনের কথা বলব কাকে?

‘কীরে তোর গোঁফ আছে?’ প্রশ্নটা শুনে প্রথমে অস্বস্তি, তার পর এক নিমেষে তা কাটিয়ে হাসিমুখে জবাব দিল মেয়েটি, ‘আছে তো! দেখছ না?’ এমন ঘটনার শিকার অনেকেই। এই ধরনের কটাক্ষ, বৈষম্য কিন্তু তিলে তিলে একটি মানুষের আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিতে পারে। প্রাচী যেমন প্রাথমিক ভাবে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিল, “এখন মনে হচ্ছে কয়েকটা নম্বর কম পেলেই ভাল হত...” কিশোরী মনের গভীর দুঃখবোধ অবশ্য তার ট্রোলদের ছুঁয়েছে কি? তা জানা নেই।

এখন প্রশ্ন উঠবে, সে দারুণ ফল করেছে, কিন্তু তার গোঁফ কেন মেনে নেব? কটাক্ষ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি তো নিজেকে গ্রুম করবে। আদতে হয় কিন্তু উল্টোটা। মানুষটি ক্রমশ গুটিয়ে যান।

এই প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বডিশেমিংয়ের নানা ধরনের মধ্যে হারসুটিজ়ম নিয়ে কটাক্ষ অন্যতম। বুঝতে হবে, এটার পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই রোগবালাই কাজ করে। যিনি কটাক্ষের শিকার, তাঁকেও কিন্তু কুরে কুরে খাচ্ছে বিষয়টা। মনে করছেন, তিনি সমাজের উপযুক্ত নন, তাঁর ওজন বেশি, তাঁর অবাঞ্ছিত রোম রয়েছে। আর তাঁর এই ভাবনায় আরও উস্কানি দিচ্ছে একের পর এক কটাক্ষ। আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, মানুষটি হয়ে পড়ছেন অ্যাংজ়াইটি ও ডিপ্রেশনের শিকার। অর্থাৎ বলা চলে ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল স্টিগমা একসঙ্গে আক্রমণ করছে।”

ডা. আবীর আরও বললেন, “অনেক সময়ে চিকিৎসকেরাও একটু কড়া ভাবে ওজন কমাতে বলেন। তবে তা স্বাস্থ্যের কারণেই। মাত্রাতিরিক্ত ওজন ডেকে আনে ডায়াবিটিস, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা বা হরমোনের সমস্যার মতো অসুখগুলো। তবে, বেশি নির্মম ভাবে বলাটা সমীচীন নয়।”

এই অ্যাংজ়াইটি ও ডিপ্রেশনের শিকার হলে মানুষের মধ্য থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ইচ্ছেটা চলে যায়। আর তা যদি চেহারা সংক্রান্ত হয়, তা হলে আয়নার সামনেই দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না একটা সময়ের পরে। নিজেকে মনে হয় অযোগ্য।

কটাক্ষ মোকাবিলার উপায়

‘এমপাওয়ারমেন্ট’— এই ধরনের কটাক্ষের প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচানোর এটাই অন্যতম উপায়। নিজের সেরা দিকটি আরও শাণিত করে তুলতে হবে। এর জন্য আক্রান্তের চিকিৎসক ও পরিজনকে সচেতন হয়ে সহায়তা করতে হবে, এমনটাই মত আবীরের। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের নিয়মিত চিকিৎসায় পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, সেই বিষয়েও ধৈর্য ধরতে হবে।

একটা কথা মাথায় রাখা সব সময়েই ভাল, দেহপটই সব নয়। স্রেফ বাহ্যিক সৌন্দর্যই সব কিছুর মাপকাঠি নয়। সুন্দরের প্রতি মোহগ্রস্ততা আমাদের অন্য অনেক বিষয়ে অন্ধ করে রাখে।

সে কথা অবশ্য প্রাচীও জানে। তাই মনখারাপ উড়িয়ে তার সপাট উত্তর, “আমি কিছু মনে করি না। চাণক্যকেও তো লোকে কটাক্ষ করত।”


ছবি: জয়দীপ মণ্ডল; মডেল: সুচন্দ্রা মণ্ডল; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্তা; হেয়ার: অঙ্কিতা দত্ত; লোকেশন ও ফুড পার্টনার: ব্লু ব্রিজ় রেস্টো কাফে, বালিগঞ্জ প্লেস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement