চুলের আমি চুলের তুমি, হেয়ার কাট দিয়ে যায় চেনা

আমরা বড়রা যদি নিজেদের আচরণে সংযত ও সচেতন হই, তা হলে হয়তো কোনও শিক্ষককে সেলুনে চিঠি লিখে ছাত্রদের চুলের কাট সম্পর্কে সচেতন করতে হবে না। লিখলেন শ্রীপর্ণা দত্ত শহরতলির কোনও এক স্কুলের প্রধানশিক্ষক এলাকার প্রায় সবকটি সেলুনে চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছেন, ছাত্ররা যেন অছাত্রসুলভ চুল না কাটে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৭:১২
Share:

ধরা যাক, আপনি ক্লাসে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন পড়াচ্ছেন, আর ছাত্রের মাথার চুল জুড়ে সাতরঙা রামধনু রং।

খুব সম্প্রতি একটি খবর আমাদের কাছে এক অন্য রকম অভিঘাত এনেছে।

Advertisement

শহরতলির কোনও এক স্কুলের প্রধানশিক্ষক এলাকার প্রায় সবকটি সেলুনে চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছেন, ছাত্ররা যেন অছাত্রসুলভ চুল না কাটে। আমরা যারা অভিভাবক বা নিতান্ত আমজনতা প্রধান শিক্ষকমশাইয়ের এমন গুরুমশাইগিরিতে নিতান্ত স্বস্তি পেয়েছি।

আমাদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। ধরা যাক, আপনি ক্লাসে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন পড়াচ্ছেন, আর ছাত্রের মাথার চুল জুড়ে সাতরঙা রামধনু রং। বা আপনি জীবনানন্দের কবিতা বোঝাচ্ছেন তো ছাত্র সামনে রোনাল্ডোর মতো চুল নিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সমীকরণ আর আগের মতো পবিত্র নেই— এ কথা প্রায় শোনা যায়। সময়ের স্রোতে আর সব কিছুর মতো বদল হয়েছে এ সম্পর্কেও। চুলের ছাঁটের বাহার তাতে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে, এই যা।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আসলে কোন আচরণটা ছাত্রসুলভ আর কোন আচরণটা আদর্শ শিক্ষক সুলভ, সে সম্পর্কে সমাজনির্মিত একটা মাত্রা আছে। যার একটু ওলটপালট হলে আমরা গেল গেল রব তুলি। ধরা যাক, কোনও এক গ্রামের স্কুলে সদ্য চাকরি পাওয়া মেয়েটা যে দিন প্রথম সালোয়ার কামিজ পরে স্কুলে যায়, প্রথাবিরুদ্ধ কাজ করার জন্য সে স্কুল কতৃর্পক্ষের বিরাগভাজন হয়। শুনতে হয়, সেই স্কুলে এর আগে কোনও দিদিমণি সালোয়ার কামিজ পরার ধৃষ্টতা দেখায়নি। অতএব, তুমিও বাপু পরবে না। সে তোমায় যতই ভোরবেলায় উঠে ট্রেন ধরতে হোক বা অন্য কিছু অসুবিধা থাকুক না কেন।

এই আমরাই তখন ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে কত কিছু বলেছি। আবার আমাদের মধ্যে কেউ কেউ স্কুলের ঐতিহ্যের দোহাই দেখিয়েছি। আসলে আমাদের মধ্যেই একটা নির্বাচন থাকে— কোনও বিষয়ে আমি প্রতিবাদী হবো আর কোনটায় হবো না। যে আমি শিক্ষিকার সালোয়ার কামিজ পরা বা শিক্ষকের জিন্‌স-টি শার্ট পরার পক্ষে কথা বলব, সেই আমিই ছাত্রের অছাত্রসুলভ চুল কাটার বিরুদ্ধে সরব হব। অবশ্য অনেকেই বলবেন— দুটো কি এক জিনিস হল? কার সঙ্গে কার তুলনা! তর্কের খাতিরে ধরে নিলে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে সকলের সমান অধিকার প্রাপ্য। তা ঠিক বেঠিক, শ্লীল অশ্লীল যাই হোক না কেন। কোনটা সুন্দর, কোনটা অসুন্দর, কোনটা শ্লীল, কোনটা অশ্লীল তার সীমা নির্ধারণ করবে কে?

অবন ঠাকুর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলীতে এ নিয়ে আমাদের যতই সচেতন করুন না কেন, এ বিতর্ক সহজে থামার নয়। আমরা ধরেই নিই যে ছেলে সলমন খানের অনুকরণে চুলের ছাঁট দিয়ে স্কুলে আসার স্পর্ধা দেখাতে পারে তার ইহকাল পরকাল ঝরঝরে। কিংবা ক্লাস নাইনে কানের পাশে লাল চুল মানেই ভবিষ্যতের সিন্ডিকেটের কর্ণধার হবে। এই যে আমরা জ্যোতিষীর ন্যায় ভবিষ্যতৎপ্রবক্তা হয়ে উঠি, তা নিজেদের কোন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে? শিক্ষা-সংস্কার আমাদের রুচি নির্মাণ করে, ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে শিক্ষা দেয় সচেতন করে। সে শিক্ষা সামাজিক, প্রথাগত, পারিবারিক যাই হোক না কেন।

শুধু চুলের ছাঁট নয়, ছাত্রদের যে কোন আচরণটি ছাত্র সুলভ আর কোনটি অছাত্র সুলভ—তার নেপথ্যেও থাকে শিক্ষা। আমরা বড়রা ঠিক কতটা তাদের ঠিক-ভুল, ভাল-খারাপ সম্পর্কে অবগত করতে পারি? ধরা যাক, বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে থাকা যে ছেলেটি বা মেয়েটি রোজ রাতে বাবার হাতে মাকে মার খেতে দেখে। পরিবার সম্পর্কে তার মনে ঠিক কী ধারণা গড়ে ওঠে, তার খবর আমরা বড়রা কতটা রাখি? বা ক্লাসের পড়া না পারা ছেলেমেয়েগুলো যখন দেখে পণপ্রথার কুপ্রভাব সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া স্যার নিজের বিয়ের পণে পাওয়া মোটর সাইকেলে ধোঁয়া উড়িয়ে রোজ স্কুলে আসেন, তাদের মনে শিক্ষক সম্বন্ধে যে ধারণা গড়ে ওঠে, তা আর যাই হোক খুব সম্মাননীয় নয়। এই তো কিছুদিন আগে নদিয়ার কামারহাটি স্কুলের এক ইংরেজি শিক্ষক তার গণিত শিক্ষিকা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছেন পণের দাবিতে। স্ত্রীর সহকর্মীদের বক্তব্য— পণের দাবিতে অত্যাচার রোজের বিষয় ছিল। পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে শিক্ষিকা স্ত্রী সব অত্যাচার মেনে নিতেন।

আবার, ছাত্রদের সাজসজ্জা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমাদেরই কেউ কেউ এমন পোশাক পরিহিত হয়ে স্কুলে পরাতে যাই, যেখানে শিক্ষিকাসুলভ রুচি প্রকাশ হয়তো সবসময়ে থাকে না। আসলে আমরা যারা বড়, তারা শুধু ছাত্রদের আচরণের দিকে অভিযোগের আঙুল না তুলে নিজেরাও একটু সচেতন হই না, যাতে আমাদের থেকেই ওরা শেখে। ক্লাসে ঠিকভাবে পড়াব না, ক্লাসের বাইরে ছাত্রকে নিজের টিউশনির ব্যবসার অংশ করব, আর চাইব ছাত্র গোপালের ন্যায় সুবোধ বালক হবে, শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে— সেটা বাড়াবাড়ি। অবশ্যই কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন, তাঁরা প্রকৃত ছাত্রদরদী, তাঁরা সব সময়েই প্রণম্য। শিক্ষক ও বাড়ির অভিভাবক এই যৌথ প্রচেষ্টায় একটা শিক্ষার্থীর ঠিক বিকাশ হয়। তার পর থাকে সমাজ থেকে সে কী শিক্ষা পাচ্ছে। সব দায়িত্ব শিক্ষকের উপর চাপিয়ে না দিয়ে অভিভাবককেও সচেতন থাকতে হয় সন্তানের আচরণ নিয়ে। হাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা হাতখরচ, স্মার্টফোন আর অনেক গৃহশিক্ষক নিয়োজিত করে আমরা অনেকেই অভিভাবকত্ব পালন করছি ভেবে নিই।

আমরা বড়রা যদি নিজেদের আচরণে সংযত ও সচেতন হই, তা হলে হয়তো কোনও শিক্ষককে সেলুনে চিঠি লিখে ছাত্রদের চুলের কাট সম্পর্কে সচেতন করতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের আচরণ সম্বন্ধে সচেতন হবে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা যে এক নয়— তা-ও তারা বুঝতে শিখবে বলেই মনে হয়।

কাটোয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement