বাবা, মা, সন্তান অর্থাৎ একটা নিটোল পরিবার। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সেই পারিবারিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার জটিলতায় জর্জরিত হয় সন্তান। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আইনত দাঁড়ি পড়ে যাওয়া মানেই সব সমস্যার নিষ্পত্তি নয়। সন্তানের দায়িত্ব কে পেলেন? যিনি পেলেন না, তিনি কী ভাবে সন্তানকে কাছে পাবেন? সন্তানকে উপলক্ষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি ফের একটা দ্বন্দ্ব শুরু হবে?
বিবাহবিচ্ছেদের আগের পর্যায়টি যথেষ্ট জটিল। স্বামী-স্ত্রী তখন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান যে, তাঁরা হয়তো সন্তানের দিকে ততটা খেয়াল করেন না। নিজেদের রোজকার অশান্তি কী ভাবে বাচ্চার উপরে প্রভাব ফেলছে, সেটা তাঁদের গোচরে আসে না। বাড়িতে অশান্তি হলে তার ফল শিশুর উপরে পড়বেই। তাই ডিভোর্স হয়ে গেলে পুরনো তিক্ততার জের না টেনে, সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মা দু’জনকেই ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
জোর দিন পজ়িটিভ দিকগুলোয়
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘ডিভোর্সের পরে বাচ্চার দেখাশোনার বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। পুরনো ঝগড়া, অশান্তি টেনে নিয়ে যাওয়ার মানে হয় না। বাচ্চার সঙ্গে বাবা ও মাকে আলাদা আলাদা ভাবে সংযোগ তৈরি করতে হবে। এটা খুব পরিকল্পিত আর সুষ্ঠ ভাবে করতে হবে।’’
যাঁর কাস্টডিতে সন্তান থাকছে, তাঁকে পরিকল্পনা করে নিতে হবে বাচ্চা সারাদিন কী ভাবে কাটাবে। কাস্টডিয়ান পেরেন্টকে যদি বাইরে কাজে যেতে হয়, তা হলে বাড়িতে সন্তান কার কাছে থাকবে এবং তার সারাদিনের রুটিন ঠিক করে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সন্তানকে নানা রকম অ্যাক্টিভিটির মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। সে যাতে ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় না কাটায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
সন্তান যে বয়সেরই হোক, বিচ্ছেদের কারণ সে জানতে চাইবেই। এ ক্ষেত্রে পায়েলর পরামর্শ, ‘‘কী কারণে বাবা-মা আলাদা হয়েছেন, সেই জটিলতা বোঝার ক্ষমতা ছোটদের থাকে না। তাই এই বিষয়কে পজ়িটিভলি দেখতে হবে। বাবা-মায়ের জবাবের উপরে নির্ভর করছে সন্তানের মানসিক গঠন। ওদের বোঝাতে হবে, বাবা-মা কোনও কারণে আলাদা হয়ে গেলেও, তাঁরা একে অপরের শত্রু নন। তাঁরা দু’জনে সন্তানের পাশে সব সময়ে থাকবেন। ওকে উপলক্ষ করে স্বামী-স্ত্রীকে কথা বলতে হবে, দেখা সাক্ষাৎ করতে পারলে আরও ভাল।’’ সন্তানের সামনে দোষারোপের চাপানউতোর নয়। নেতিবাচক কথাবার্তা ওদের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ডিভোর্সের পরে বাবা-মায়ের মধ্যে সহজ সম্পর্ক বাচ্চাটি প্রত্যক্ষ করলে তার ব্যক্তিত্বের ভিত্তি মজবুত হয়।
অকারণ সহানুভূতি নয়
যে সব বাচ্চাদের মা-বাবা আলাদা হয়ে গিয়েছে, তাদের অনেক সময়ে সহানুভূতির চোখে দেখা হয়। এই অকারণ সহানুভূতি ছোটদের বিষণ্ণ করে তোলে। বাকিদের চেয়ে সে নিজেকে আলাদা ভাবতে থাকে। অনেক সময়ে বাড়ির বয়স্করা ‘আহা ও বাবা/মাকে কাছে পায় না’ জাতীয় কথা বলেন, যা বন্ধ করা জরুরি।
নিজেদের ইনসিকিয়োরিটি দূর করুন
আইনজীবী অতনু রায়চৌধুরী জানালেন, বিশেষ কোনও কারণ না ঘটলে আদালত মাকেই কাস্টডি দেয়। সে ক্ষেত্রে সপ্তাহে এক-দু’দিন বাবা সন্তানের সঙ্গে েদখা করতে পারবেন। কাস্টডির বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ডিভোর্সের পরে যিনি কাস্টডি পেলেন না, তাঁর মনে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। সন্তানকে যে সময়টুকু তিনি কাছে পাচ্ছেন, সেটুকুতেই বাচ্চার সব আবদার পূরণের চেষ্টা করেন। দামি জিনিস কিনে দেওয়া, রেস্তরাঁয় খেতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। পায়েল ঘোষের মতে, ‘‘মাঝেমধ্যে সন্তানকে প্যাম্পার করা যেতে পারে। কিন্তু নিয়মিত নয়। তার চেয়ে বাচ্চার সঙ্গে গল্প করুন। ওর মনের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করুন। দু’জনে কোনও অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত হতে পারেন।’’
যাঁর কাস্টডিতে বাচ্চা থাকে, তাঁর মধ্যেও ইনসিকিয়োরিটি তৈরি হয়। অন্য জন যদি বাচ্চাকে নিজের দলে টেনে নেয়... এমন ভাবনাও আসে। এমন ভাবনা আখেরে সন্তানেরই ক্ষতি করে। মনে রাখবেন, বাচ্চার কিন্তু বাবা-মা দু’জনকেই চাই। সম্ভব হলে দু’জনে মিলে ওকে নিয়ে বেরোতেও পারেন। সন্তানের কেরিয়ার, তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাবা-মাকে একসঙ্গে নিতে হবে। দু’জন অভিভাবক যখন দেখা করবেন, তাঁরা তখন বাচ্চার ভাল-মন্দ নিয়ে কথা বলুন। আগে থেকে মন শক্ত করে রাখুন, পুরনো তিক্ততার অধ্যায় খুলে বসবেন না।
ধীরে চলো নীতি
ডিভোর্সের পরে অনেকেই নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবেন। কিন্তু বাবা-মায়ের ডিভোর্স সন্তানের কাছে বড় ধাক্কা। তার উপর যদি নতুন কাউকে ‘বাবা’ বা ‘মা’ বলতে হয়, সেটা তার উপর আরও বেশি চাপ তৈরি করবে। এ সব ক্ষেত্রে সময় নিয়ে নতুন বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে তোলা প্রয়োজন।
তৈরি হয় আচরণগত সমস্যা
স্বাভাবিক পরিবারে বেড়ে ওঠা বাচ্চা এবং বিবাহবিচ্ছিন্ন বাবা-মায়ের সন্তানের বড় হওয়ার মধ্যে কিছু ফারাক থাকে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবলীনা ঘোষ বলছিলেন, ‘‘বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি চললে বা তাঁদের ডিভোর্স হলে সন্তানের মধ্যে আচরণগত সমস্যা তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। যখন ওরা বুঝতে পারে, মা-বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে, তখন ওরা প্লেয়িং ওয়ান এগেনস্ট দি অ্যানাদার করতে থাকে। ভাঙা পরিবারে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে অপরাধের ঘটনাও বেশি।’’ শিশুর মধ্যে আচরণগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে কি না, তা বোঝা যায় মূলত স্কুল থেকে। কখনও তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে, অকারণে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করে, বাবা-মা যা খুশি করতে পারলে আমিও তা পারব— এ ধরনের আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও এ সব ক্ষেত্রে খুব বেশি থাকে। ‘‘সাধারণত স্কুল থেকেই আমাদের কাছে রেফার করা হয়। বাচ্চার সঙ্গে বাবা-মায়ের কাউন্সেলিংও জরুরি। অনেক সময়ে সেকেন্ডারি কেয়ারগিভারকেও কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনা হয়। তবে যতই কাউন্সেলিং করা হোক না কেন, বাড়ির পরিবেশ সুস্থ হওয়া খুব জরুরি,’’ মন্তব্য দেবলীনা ঘোষের।
সন্তানের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই তাকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। কোনও বাবা-মা যখন তার ছেলে বা মেয়েকে থেরাপি করাতে নিয়ে যাচ্ছেন, তার অর্থ তিনি সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। এটা ইতিবাচক দিক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যত ঝড়ই বয়ে যাক, সন্তান যে তাঁদের দু’জনের ভালবাসার, সেটা মনে রাখাটা ভীষণ ভাবে জরুরি।