তৃতীয় ঢেউয়ে এখনও পর্যন্ত যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই অত্যন্ত মৃদু উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।
শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব, সঙ্গে মাথা ভার, শুকনো কাশি ছিল বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত যুবকটির। প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি তিনি। ভেবেছিলেন, শীতের প্রকোপে এমন হয়েছে। কিন্তু পরিজনদের চাপে করোনা পরীক্ষা করান ওই যুবক। রিপোর্ট আসে পজ়িটিভ।
শুধু ওই যুবকই নন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তৃতীয় ঢেউয়ে এখনও পর্যন্ত যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই অত্যন্ত মৃদু উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। যা অনেকেই করোনা বলে প্রথমে মানতে চাইছেন না। ভাইরাসের চরিত্র বদলের সঙ্গেই উপসর্গের এমন পরিবর্তন বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা এটাও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, উপসর্গ মৃদু হলেও সতর্ক থাকতে হবে। না হলে বিপদ বাড়বে।
শহরের এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, “বেশ কিছু রোগী অজানতেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। কারণ তাঁরা বুঝতে চাইছেন না, করোনার উপসর্গে বদল ঘটেছে। ভাবছেন, সব কিছুই শীতের সময়ে ঠান্ডা লাগার ফল। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়টা তেমন নয়।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বার বার নিজের চরিত্র বদলাচ্ছে করোনাভাইরাস। আলফা, বিটা, গামার মতো এসেছিল ডেল্টা। তার পরে এখন দেখা যাচ্ছে ওমিক্রন। করোনাভাইরাসের এই নতুন প্রজাতিতে যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের উপসর্গ দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তদের থেকে অন্য রকম।
সেই সময়ে জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ ভাব, আচমকা শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। তৃতীয় ঢেউয়ে সেই উপসর্গে বদল ঘটেছে বলেই জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার। তিনি জানাচ্ছেন, মূলত দু’ধরনের রোগী আসছেন। এক দলের টানা কয়েক দিন ধরে তীব্র জ্বর, বমি, সঙ্গে শরীরে অস্বস্তি। তবে সব চেয়ে বেশি রোগী আসছেন জ্বর, গলা ব্যথা, শুকনো কাশি, মাথা ভারের মতো সমস্যা নিয়ে। অরুণাংশুবাবু বলেন, “প্রথম ঢেউয়ে অধিকাংশের স্বাদ-গন্ধ চলে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকলেও এখন তা হচ্ছে না।’’
বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের বক্ষরোগ চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরীর কথায়, “ভাইরাসের ক্রমাগত মিউটেশন হচ্ছে। অর্থাৎ, পরিচিত যে ডেল্টা প্রজাতি, তারও চারিত্রিক বদল ঘটেছে। আবার নতুন ভাবে এসেছে ওমিক্রন। দু’টিই অত্যন্ত সংক্রামক। কিন্তু কামড় কিছুটা কম হওয়ার ফলে উপসর্গের
বদলও ঘটেছে।’’
ভাইরাসের নতুন প্রজাতিকে অবহেলা করে কোভিড-বিধি না মানলে বিপদ অনেক বাড়বে বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলছেন, “ওমিক্রনকে অতি রুগ্ণ একটি ভাইরাস বলে ধরে নিলেও তাতে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এটি অত্যন্ত দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন, তত সঙ্কটজনক রোগীর সংখ্যাও একটা সময়ে বাড়তে শুরু করবে। তাই সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে মানুষকেও সতর্ক হতে হবে।’’
কিন্তু শহর ও সংলগ্ন জেলার এক শ্রেণির মানুষ কি আদৌ সতর্ক? প্রশ্ন তুলছে চিকিৎসক মহল। কারণ, এখনও কলকাতা থেকে উত্তর ২৪ পরগনা ও হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির মানুষ করোনা-বিধি উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাজ্যে দৈনিক যত জন আক্রান্ত হচ্ছেন, তার প্রায় অর্ধেক কলকাতার। চিকিৎসক মহলের পর্যবেক্ষণ, অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে দিন রাজ্যে আক্রান্ত শিখরে পৌঁছেছিল, সে দিনও শহরে সংক্রমিতের সংখ্যা তত বেশি ছিল না। যেমন, ২০২০-র ২২ অক্টোবর সর্বাধিক আক্রান্ত ছিলেন ৪১৫৭ জন। ওই দিন শহরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮৭৪। আবার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ২০২১-এর ১৪ মে আক্রান্তের
সর্বাধিক সংখ্যা হয়েছিল ২০৮৪৬। সে দিন কলকাতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৯৫৫ জন। সেখানে তৃতীয় ঢেউয়ে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছনোর বহু আগে থেকেই রাজ্যের মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা কলকাতার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বললেন, “ওমিক্রন কিংবা মিউটেশন হয়ে আসা নতুন স্ট্রেন যা-ই হোক না কেন, তাতে সংক্রমণের হার মারাত্মক। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, কলকাতার মতো ঘন বসতিপূর্ণ জায়গায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন। আর এখানে যে হেতু পরীক্ষার সুবিধাও বেশি, তাই কেউ সংক্রমিত কি না, তা-ও সহজে জানা যাচ্ছে।’’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, আগের চেয়ে এ বারের ভেরিয়েন্ট অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম থেকেই বার বার বলা হচ্ছে, এ বারের ভাইরাস অনেক বেশি সংক্রামক। কিন্তু সেটা কতটা গুরুতর রোগ ডেকে আনতে পারে, তা জানতে তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার থেকে আরও কিছু দিন, অর্থাৎ দিন দশ-বারো অপেক্ষা করতে হবে। তাই সতর্কতাই এখন একমাত্র পথ।