একা কান্নায় আর আস্থা রাখতে পারছেন না জাপানি মেয়েরা।
ডিভোর্সের একাকিত্ব হোক বা কোনও যন্ত্রণা— সে সবের কারণে চোখ দিয়ে জল বেরনোর আগেই কম্পিউটার বা ফোনের সামনে বসছেন জাপানি মেয়েরা। অনলাইনে চলছে হ্যান্ডসাম ছেলের খোঁজ!
কারণ, কান্নার সময় এ বার সুদর্শন পুরুষের সামনে কাঁদার রেওয়াজই চালু হয়েছে জাপানে। তার জন্য খরচও হচ্ছে কিছুটা। সব মিলিয়ে এক বার কাঁদার খরচ ভারতীয় মুদ্রায় দু’-তিন হাজারের মতো। এ নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন জাপানি এক উদ্যোগপতি। ‘রুদালি’ ছবির কথা মনে আছে? সেখানে নিজের কান্না কেঁদে দেওয়ার জন্য লোক ভাড়া করার গল্প ছিল। তবে সে তো ফিল্মি দুনিয়ার গল্পগাথা। এ বার প্রখর বাস্তবে নিজেই কাঁদছেন নিজের কান্না, তবে সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে!
এমনিতে আবেগের সব ভাঁড়ার মজুত রয়েছে পিটুইটারির ঘরে। দুঃখ বা কান্নার মুহূর্ত এলে পিটুইটারি সঙ্কেত পাঠাবে টিয়ার গ্ল্যান্ডে। তাতে চাপ পড়ে জল বেরিয়ে আসবে চোখের কোণ বেয়ে। জীববিদ্যার নিয়ম এ কথা বলে। কিন্তু যে কথা বলে না, তা হল মেয়েদের কান্নার সময় এই সুন্দর মুখের পুরুষের তত্ত্ব। তবে সেই ভাবনাকেই মূলধন করে নতুন এই অভ্যাসে মেতেছেন জাপানি মেয়েরা। তাঁদের একাংশের বিশ্বাস, সুদর্শন পুরুষ চোখের জল মোছালে তবে নাকি সে কান্না কেঁদেও সুখ! সঙ্গগুণে ঝরে যাবে দুঃখকষ্টও। কেমন করে?
আরও পড়ুন: ঘাড় গুঁজে মোবাইলে সারা ক্ষণ? কী বিপদ ডেকে আনছেন জানেন?
একা কান্নার চেয়ে সুদর্শন পুরুষের সামনে কান্নায় মনের বার লাঘব হয় বলে মনে করেন জাপানিদের একাংশ।
জাপানি উদ্যোগপতি হিরোকি তেরাই এইনতুন ব্যবসা খুলে বসেছেন। মেয়েরা কাঁদলে ঝকঝকে চেহারার সুপুরুষ পৌঁছে যাবে তাঁদের কাছে। কাজ? সান্ত্বনা দেওয়া, যত্ন করে চোখের জল মোছানো। তাঁদের নামও দিয়েছেন তিনি, ‘হ্যান্ডসাম উইপিং বয়’।জাপানি পরিভাষায় এই পদ্ধতির নাম ‘রুই-কাৎসু’। কাঁদতে চাইলে অনলাইনে বুক করতে হবে নিজের নাম ও কাঁদার সময়। ব্যস! এটুকুই যথেষ্ট। এ বার সেই ঠিকানায় পৌঁছে যাবেন সুদর্শন যুবক।কান্নার সময় খুব প্রিয় মানুষ সামনে থাকলে আবেগের গতি ও প্রকাশ বিশুদ্ধ হয়, কান্না প্রকাশের ঠিকঠাক মাধ্যম পেলে তা অনেক স্বাস্থ্যকর হয়— দুনিয়া জুড়ে এমন দর্শনে বিশ্বাস করেন অনেকেই। আর এই বিশ্বাসকে মূলধন করেইতেরাই এই পদ্ধতি চালু করেছেন।
কিন্তু এমন ভাবনা কেন ভাবলেন তেরাই? তাঁর মতে, এই ভাবনার কথা প্রথম মাথায় আসে জাপানি দম্পতিদের ডিভোর্সের সময়ের কথা ভেবে। সেখানে কিছু পুরুষ সপ্তাহভর নানা কাজ ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় মেয়েরাই ডিভোর্সের আবেদন করে। তখন সংসার ভেঙে যাওয়ার কষ্ট উভয়কেই পীড়া দেয়। কিন্তু সে দুঃখ ভুলে থাকার কায়দা দু’জনের দু’রকম। স্বভাবজাত কারণে সাধারণত পুরুষরা সারা দিন নানা প্রমোদ, বিলাসিতা ও ঘুমিয়ে বা পরের সপ্তাহে কাজের পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দেন। সে ক্ষেত্রে মেয়েরাই কান্নাকাটি করেন বেশি।
তা দেখেই এই ব্যবসার কথা মাথায় আসে তেরাইয়ের। তিনি ভেবে দেখেন, তাঁদের সামলাতে যদি সামনে কোনও বিপরীত লিঙ্গের মানুষ থাকেন, তা হলে তাঁরা অনেকটা ভরসা পাবেন, কান্নায় সমব্যথী হওয়ার জন্য মনের মতো মানুষ পাবেন।এতে এক জন দুঃখী মানুষ সঙ্গীও পাবেন, আবার মেয়েদের মনের চাপও কমবে।
আরও পড়ুন: মোবাইলেই সময়, ফুরোচ্ছে কি ঘড়ির দিন?
কিন্তু সুদর্শন পুরুষই কেন? তেরাইয়ের মতে, সামনের মানুষ বদলে গেলে একই ঘটনায় মানুষের আচরণও অনেকটা বদলে যায়।সামনে আকর্ষক কেউ থাকলে মানুষ কোথাও জীবনের প্রতি একটু বেশি আশাবাদী হয়। তাই সুন্দর মুখকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
তেরাই এই অভিনব ব্যবসা শুরু করে ফলও পান হাতেনাতে। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর এই ভাবনার কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে ও বিপুল লাভবান হন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তাঁর এই ভাবনাকে মূলধন করে ছবিও বানিয়ে ফেলেছেন দ্যারিয়েল থমস। তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘ক্রাইং উইথ দ্য হ্যান্ডসাম ম্যান’-এ তিনি এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন। প্রথম জীবনে ফোটোগ্রাফি করে বেড়ানো থমসের হঠাৎই নজরে পড়ে একটি পত্রিকায় মহিলাদের কান্নার সঙ্গী হওয়ার বিষয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা। তখনই ছবিটির কথা মাথায় আসে তাঁর। এই ধারণার জনক হিরোকি তেরাইয়ের সন্ধানও পান তিনি। থমসের এই ছবি জাপান জুড়ে এমন অভিনব ব্যবসাকে আরও প্রচারের আলোয় এনেছে।
যদিও জাপান জুড়ে বিপুল জনপ্রিয় হওয়া এই অভ্যাসকে আদতে তাঁদের ‘সেরিমনিয়াল অ্যাটিটিউড’ বা ‘উদ্যাপনের অভ্যাস’ হিসাবেইদেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভাবনা থেকে বাদ নেই কলকাতার মনোবিদরাও। জাপানে মেয়েদের এমন কান্নার বিষয়কে তাঁরাও ‘উদ্যাপনের হুজুগ’ হিসাবেই দেখছেন। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়: ‘‘সান্ত্বনা খোঁজার জন্য প্রিয় মানুষ কাছে থাকলে আরাম হয়, তা সত্যি। কান্নার প্রাবল্যও তাতে কমে। কিন্তু তার জন্য সুন্দর মুখ প্রাধান্য পাবে, এমনটা নয়। এমনকি, ছেলেই প্রয়োজন এমনও নয়। সমকামী মেয়েরা তবে কান্নার জন্য কোথায় যাবেন? তা ছাড়া কান্নার বিষয় এলেই শুধু মেয়েদের বিষয় করে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে থাকলেও মনে রাখতে হবে, ছেলেদেরও টিয়ার গ্ল্যান্ড থাকে। আর তাতে চাপ পড়লে ব্যক্তিত্বে চাপ পড়ে না।’’
আরও পড়ুন: এই সব জিনিস বেসিন বা নর্দমায় ভুলেও ফেলবেন না
মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় আবার এই বিষয়টিকে নেহাত হুজুগ হিসাবে দেখতে নারাজ। তাঁর মতে, এটা ব্যবসা বলে বিষয়টাকে হুজুগের আকারে দেখছি আমরা। কিন্তু কান্নার প্রকাশের সময় সাধারণ ভাবে কোনও বিপরীত লিঙ্গের বা সমকামীদের ক্ষেত্রে সমলিঙ্গের আকর্ষক মানুষ সামনে থাকলে ও তিনি সান্ত্বনা দিলে কান্নার প্রাবল্য কমে। একা কান্নায় যে বিষাদ তা কিন্তু কারও সামনে কাঁদলে এত প্রবল ভাবে আসে না। সে দিক থেকে এ ভাবনা মনস্তত্ত্ব ভেবেই।
তবে এখানে একটি বিষয়ে দ্বিমত তিনিও। তাঁর মতে, ‘‘আমার আপত্তি নতুন কোনও আকর্ষক পুরুষের ধারণায়। এখানেই মনস্তত্ত্বের সঙ্গে ব্যবসা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বরং, কাছের কোনও পছন্দের বন্ধু পাশে থাকলে সান্ত্বনা দিলে দুঃখ প্রশমিত হয় দ্রুত।’’
সুতরাং জাপানে গিয়ে মেয়েরা কাঁদতে চাইলে রুমাল আর সান্ত্বনার আর অভাব নেই! শুধু দরকার রেস্ত, আর একটা ক্লিক!
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)