কিছু রোগ থাকে, যারা এমনিতে নিরীহ। নাম শুনলে মোটে ভয় করে না। বরং ‘ও তো সবারই হয়, এমন কিছু ঝামেলা করে না’-গোছের আশ্বাস মেলে। ফ্যাটি লিভার অনেকটা সেই গোত্রেরই রোগ। কিন্তু সত্যিই কি এই রোগে বিপদ তেমন কিছু নেই? লিভারে ফ্যাট জমাটা কি নেহাতই স্বাভাবিক কোনও ঘটনা? চিকিৎসকরা কিন্তু এমনটা মনে করেন না। ফ্যাটি লিভার আসলে অনেক বড় আর জটিল রোগের প্রথম ধাপমাত্র। ঠিক সময়ে যত্ন না নিলে তা ভবিষ্যতে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
রোগটা কী?
যকৃৎ বা লিভার আমাদের শরীরের ভিতরের অঙ্গগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড়। আমরা যা খাই, তা হজম করতে, খাবার থেকে পাওয়া শক্তি সঞ্চয় করতে আর টক্সিন বর্জন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ লিভারই করে থাকে। এই লিভারের কোষে নানা কারণে ফ্যাট জমে। খুব অল্পস্বল্প ফ্যাট জমলে তা স্বাভাবিক। কিন্তু চর্বির পরিমাণ বাড়লেই ঝামেলা। ফ্যাটি লিভার দু’ধরনের হয়— অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজ়িজ় (এএফএলডি) এবং নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজ়িজ় (এনএএফএলডি)।
প্রথম ধরনের ফ্যাটি লিভারের নাম থেকেই বোঝা যায়, অত্যধিক অ্যালকোহল সেবনের ফল এটি। অ্যালকোহল যত বেশি ঢুকবে শরীরে, ততই বিপজ্জনক হারে বাড়বে লিভারে ফ্যাট জমার পরিমাণ। পরবর্তী কালে অ্যালকোহল-জনিত লিভারের নানা রোগ, এমনকি লিভারে সিরোসিসও হতে পারে। ফলে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে বিপদের আশঙ্কা তুলনায় অনেক বেশি। দ্বিতীয় ধরনের ফ্যাটি লিভারের কারণ হরেক রকম। ওবিসিটি, হাই সুগার, হাই লিপিড প্রোফাইল, হাই ব্লাড প্রেশার বা হাই বিএমআই-এর ফল হিসেবেও লিভারে ফ্যাট জমে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনিতেই শরীরে মেদ জমার প্রবণতা বেশি থাকে বলে ফ্যাটি লিভারের সম্ভাবনাও বেশি। প্রেগন্যান্সিতেও অনেক সময়ে ফিমেল হরমোনের আধিক্যের কারণে ফ্যাটি লিভার হয়।
বুঝবেন কী করে?
মেডিসিনের চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল জানালেন, ফ্যাটি লিভার আগাম বোঝার কোনও উপায় নেই। খিদে কমে যাওয়া, বমি ভাব, গায়ে চুলকানির মতো সাধারণ কিছু লক্ষণ আছে বটে। কিন্তু সেটাও বোঝা যায়, যখন লিভারের ক্ষতি অনেকখানি হয়ে গিয়েছে তার পরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে ইউএসজি করাতে গিয়ে। অন্য কোনও রোগের জন্য ইউএসজি করাতে হয়েছে এবং পরীক্ষায় ফ্যাটি লিভার ধরা পড়েছে, এমন রোগীর সংখ্যাই বেশি। তবে ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসার জন্য আসা রোগীর ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখে নেওয়া হয়, তিনি কোন স্টেজে আছেন। ফ্যাটি লিভারের পরবর্তী ধাপ হল ইনফ্ল্যামেশন। অর্থাৎ ক্রমাগত ফ্যাট জমতে জমতে লিভার খানিকটা ফুলে ওঠে। এর পরবর্তী ধাপ ফাইব্রোসিস। এক ধরনের স্ক্যান করে দেখে নেওয়া হয়, লিভার কতটা শক্ত হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ পর্যায় হল লিভার সিরোসিস বা লিভার ফেলিয়োর। খাদ্যনালীর ভিতরে রক্তপাত শুরু হয়ে যায় এ সময়ে। এ ক্ষেত্রে যকৃৎ প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। এই পর্যায়ে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি।
সারবে কী করে?
ডা. সুবীর মণ্ডল জানাচ্ছেন, ফ্যাটি লিভারের রোগী তাঁদের কাছে এলেই তাঁরা চিকিৎসা শুরু করে দেন না। আগে পরামর্শ দেন, লাইফস্টাইল পাল্টানোর। অনেক ক্ষেত্রে এইটুকুতেই কাজ হয়ে যায়। কেমন সেই পরিবর্তন? যাঁদের অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজ়িজ়, তাঁদের ক্ষেত্রে ওষুধ একটাই, অ্যালকোহল বন্ধ করা। নন-অ্যালকোহলিক হলে, প্রথমেই জেনে নেওয়া হয় রোগের ইতিহাস কী। সেই মতো চিকিৎসা শুরু হয়। ওজন অত্যধিক বেশি হলে সবচেয়ে আগে তাকে বিএমআই মেনটেন করতে বলা হয়। তার পরে প্রয়োজনে ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধের মধ্যে সাধারণত আরসোডিঅক্সিকোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ই, কয়েক ধরনের সুগারের ওষুধ বা অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। তবে ওষুধ বন্ধ করলে যেহেতু এই রোগ ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়, তাই ওষুধের পরিবর্তে জীবনযাপনের ধারা বদলানোর উপরেই চিকিৎসকেরা জোর দেন বেশি।
কী করা উচিত?
সবার আগে বিএমআই মেনটেন করতে হবে। কারও বিএমআই নির্ভর করে তাঁর উচ্চতা ও ওজনের হিসেবের উপরে। সাধারণ ভাবে বিএমআই-এর ঊর্ধ্বসীমা ধরা হয় ২৫। কিন্তু তা ৩০ ছাড়িয়ে গেলে ‘সিভিয়র ওবিসিটি’ বলে ধরা হয়। ফ্যাটি লিভারের রোগীর বিএমআই বেশি থাকলে তাকে আগে ওজন কমাতে হবে। সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম। খাবারের মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আর ট্রান্স ফ্যাট অবশ্যই কমাতে হবে। আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট নিয়ে সমস্যা হয় না। সরষের তেল নিয়ে খুব বেশি হইচই হলেও এটা তেমন ক্ষতি করে না, যতটা করে কেকের মধ্যে থাকা ট্রান্স ফ্যাট। এড়িয়ে চলতে হবে ক্র্যাকার, কুকি, জাঙ্ক ফুড জাতীয় খাবারও। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং সুস্থ জীবনযাপনে ভরসা রাখলে লিভারও ভাল থাকবে।
মডেল: সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা, স্নেহা বসু; ছবি: শুভজিৎ শীল
মেকআপ: সুমন গঙ্গোপাধ্যায়; হেয়ার: অভিজিৎ দাস
লোকেশন: হোটেল স্যাফায়ার, নিউ মার্কেট