নানা রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে পেট ব্যথা। ব্যথার ধরন, কোন দিকে ব্যথা হচ্ছে... ইত্যাদি বিষয় দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়
stomach pain

Abdominal Pain: পেটের ব্যথা অবহেলা করবেন না

অনেক রোগের উপসর্গ হিসেবেই দেখা দিতে পারে পেটের ব্যথা। কিন্তু অনেকেই গ্যাসের ব্যথা ভেবে বিশেষ পাত্তা দেন না।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:০২
Share:

বেশ ক’দিন ধরেই পেটে ব্যথা হচ্ছে সৃজার। প্রথম দিকে গ্যাসের ব্যথা ভেবে অনেকটা জল খেয়েছেন, হজমের ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু কোনও ভাবেই ব্যথা থেকে রেহাই নেই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল সৃজার গলব্লাডার স্টোন হয়েছে।

Advertisement

এ রকম অনেক রোগের উপসর্গ হিসেবেই দেখা দিতে পারে পেটের ব্যথা। কিন্তু অনেকেই গ্যাসের ব্যথা ভেবে বিশেষ পাত্তা দেন না। পরে পেটে ব্যথা বাড়লে যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, তখন রোগ অনেক বেড়ে যায়।

Advertisement

পেটে ব্যথা কেন হয়?

মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘পেটে ব্যথার কারণ বুঝতে হলে পেটের মধ্যে কোথায় কী আছে, সেটা জানতে হবে। পেটের ভিতরটাকে ন’টি ভাগে ভাগ করে নিলে উপরে ডান দিকে রয়েছে লিভার ও গলব্লাডার। পাঁজর যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে উল্টো ভি শেপের খাঁজের মতো অংশের নীচে রয়েছে প্যানক্রিয়াস। ফলে অনেকে বুকের নীচের ওই খাঁজে ব্যথা হলে যে গ্যাসের ব্যথা ধরে নেন, সেটা ভুল। সেটা প্যানক্রিয়াটাইটিসের উপসর্গ হতে পারে। আবার স্ট্রোকের আগেও এখানে ব্যথা হতে পারে। এই অংশের ব্যথা নিয়ে সচেতনতা জরুরি। এর পরে উপরের বাঁ দিকে থাকে প্লীহা ও পাকস্থলী। তার নীচে অর্থাৎ কোমরে দু’হাত দিয়ে দাঁড়ালে যেখানে হাত পড়ে, সেখানে পেটের দু’দিকে থাকে কিডনি। রেনাল রোগের ক্ষেত্রে পিঠের দিক থেকে সামনের দিকে নেমে আসে সেই ব্যথা। আর নাভির চারপাশকে বলে পেরি-আম্বিলিকাল এরিয়া। এর পরে নীচে ডান দিকে কুঁচকির উপরে থাকে অ্যাপেন্ডিক্স আর খাদ্যনালির সিটাম বলে একটা অংশ। তার নীচে তলপেটের অংশে রয়েছে মূত্রথলি আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ইউটেরাস।’’

ফলে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হতে পারে পেটে ব্যথা। তবে এই অরগ্যানগুলো আক্রান্ত হলেই যে পেটে ব্যথা হবে, তা কিন্তু নয়। এ ছাড়াও কোলনের সমস্যায় পেটে ব্যথা হতে পারে। রয়েছে মিউকাসের সমস্যাও। আর পেরি-আম্বিলিকাল এরিয়ায় ব্যথা কিন্তু বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সেই অবধি যেমন অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা ছড়ায়, তেমন মিউকাসজনিত কারণেও নাভির চারপাশে ব্যথা হতে পারে। ওভারির সমস্যা থেকেও এখানে ব্যথা হতে পারে। প্রাথমিক ভাবে ব্যথা কোথায় হচ্ছে আর ব্যথার ধরন বুঝেই চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করতে দেন।

জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীরকুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘পেটে ব্যথা হওয়া এক দিক থেকে ভাল। শরীরের ভিতরে কোনও রোগ আছে কি না, তা জানান দেয় ব্যথা। সেটা কোনও টিউমর বা ইনফেকশন- জনিত কারণে বা ওয়র্মস আটকে গেলেও হতে পারে। তার বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিক্রিয়ায় এই পেটে ব্যথার সূত্রপাত। আমাদের পেশি দু’রকমের। কিছু পেশি আমরা পরিচালনা করতে পারি, কিছু পারি না। পেটের ভিতরের পেশি হল ইনভলান্টিয়ারি মাসল, সেগুলি পরিচালনা করা যায় না। সেগুলি নার্ভের সাহায্যে

সেল্ফ-রেগুলেটেড হয়ে সেই জায়গার পেশি সঙ্কুচিত হলে পেটে ব্যথা হয়।’’

ব্যথা দু’ভাবে হতে পারে। কিছু অ্যাকিউট পেন, কিছু ক্রনিক। ক্রমাগত যে পেন বেড়ে যায় তা হল ক্রনিক। ‘‘অ্যাকিউট ব্যথা তীব্র হওয়ায় মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়। দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক পেন তীব্র না হলেও কিন্তু অবহেলা করা যাবে না। ক্যানসারের উপসর্গও হতে পারে এ ধরনের ব্যথা,’’ মনে করিয়ে দিলেন ডা. মণ্ডল।

ব্যথার ধরন বুঝতে হবে

কখনও হয়তো প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হল। কিছুক্ষণ থেকে কমে গেল। আবার কিছু ক্ষেত্রে টনটন করে সারাক্ষণ ব্যথা হয়। ডা. সুবীরকুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘অনেক সময়ে দেখা যায়, খালি পেটে থাকার পরে খাবার খেলে ব্যথা হচ্ছে, সেটা গ্যাসট্রিকের ব্যথা। আবার পেট খালি থাকলে ব্যথা বাড়ে ডিয়োডিনাল আলসার হলে। কখনও পিঠের দিক থেকে যদি ব্যথা পেটের সামনের দিকে আসে, তখন ইউরেটারে পাথর আটকে আছে সন্দেহ করা হয়। গলব্লাডারে পাথর থাকলে পেটের ডান দিকে উপর দিক থেকে জোরে ব্যথা ওঠে, আবার কমে যায়। ৪০-এর কাছাকাছি বয়সি মহিলাদের (যাঁদের শরীর ভারী) গলব্লাডারে পাথর হতে বেশি দেখা যায়।’’

ডা. তালুকদারও কিছু ব্যথার চরিত্র পর্যালোচনা করলেন, ‘‘কণ্ঠার কাছে যদি ব্যথা হয়, হয়তো কিছু খেলে ব্যথা কমছে বা খালি পেটে থাকলে কমছে, সেটা অ্যাসিডিটির ব্যথা। কিন্তু সেই ব্যথাটাই যদি পিঠের কাছে হয়, অর্থাৎ কণ্ঠার ঠিক বিপরীত দিকে পিঠের কাছে যদি ব্যথা হয়, তা হলে বুঝতে হবে সেটা প্যানক্রিয়াসের ব্যথা। এই ব্যথা ডিপ-রুটেড হয়। ব্যথা কোথা থেকে হচ্ছে, তার চরিত্র কেমন, কতক্ষণ থাকছে, তার সঙ্গে আর কী কী সমস্যা রয়েছে... এই সব কিছু বিবেচনা করেই রোগনির্ণয় করা হয়।’’ পেটের এক দিকে ব্যথা হচ্ছে মানেই সেটার কারণ সেই অরগ্যান, ধরে নেওয়া ঠিক নয়। একই জায়গায় বিভিন্ন রোগের কারণে ব্যথা হতে পারে। যেমন কোলাইটিসের ব্যথা কিন্তু পেটের বাঁ দিকের একদম নীচে হয়। সে ক্ষেত্রে পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা হয়। তার পরে মলত্যাগ করার পরে সেই ব্যথা আস্তে আস্তে কমে যায়। আবার সেখানেই হতে পারে ইউটিআইয়ের ব্যথা বা বাঁ দিকের ওভারির টিউমর বা ইক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ব্যথা।

এ ক্ষেত্রে আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে। অনেক সময়ে দীর্ঘক্ষণ ব্যথা হলে রোগীর ব্যথা আর লোকালাইজ়ড থাকে না। তখন সারা পেটেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঠিক কী কারণে কোথা থেকে ব্যথা হচ্ছে, তা ধরা মুশকিল হয়ে যায়। তখন চিকিৎসকেরা ব্যথা কমানোর জন্য অ্যান্টি-স্প্যাজ়মোটিক ওষুধ দিয়ে অপেক্ষা করেন। পেটের পেশির স্প্যাজ়ম কমে গেলে নির্দিষ্ট যে জায়গা ব্যথার উৎস, তা ধরা সহজ হয়। কিছু ক্ষেত্রে রোগনির্ণয় করতে ইউএসজিও করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটা কথা মনে করিয়ে দিলেন ডা. অরণাংশু তালুকদার, ‘‘অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা কিন্তু ইউএসজিতে ধরা পড়ে না। সেটা ক্লিনিক্যালি রোগীকে দেখে চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন।’’

পেনকিলার খাবেন না

অনেকেই পেটের ব্যথা কমাতে নিজেই পেনকিলার জাতীয় ওষুধ খেয়ে নেন। এই ধরনের ওষুধ খাওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন ডা. সুবীরকুমার মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘হাতে, পায়ের পেশিতে ব্যথা হলে অনেকে পেনকিলার খান ব্যথা কমানোর জন্য। এ বার ধরুন স্টম্যাক আলসার হয়েছে। কিন্তু রোগী সেটা জানে না। পেটের ব্যথা কমানোর জন্য দোকান থেকে আইবুপ্রফেন বা অ্যাসপিরিন জাতীয় পেনকিলার খেয়ে নিলেন। এতে কিন্তু ব্যথা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আখেরে ক্ষতি হবে রোগীরই। এই ধরনের ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকেরা অ্যান্টি-স্প্যাজ়মোটিক ওষুধ দেন। গলব্লাডার বা কিডনি স্টোনের ক্ষেত্রেও তাই।’’

শিশুদেরও পেটে ব্যথার নানা কারণ থাকে। ছোট বাচ্চাদের কলিক পেন হয় ঠিকই। কিন্তু সব ব্যথাই কলিক পেন হিসেবে ধরে নেবেন না। খেয়াল রাখবেন, শিশু কতক্ষণ কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে পা ভাঁজ করে ‘দ’-এর মতো শরীরটা বেঁকে যাচ্ছে কি না, খাওয়ার পরে কাঁদছে না খাওয়ার আগে। দু’-তিন দিন অবজ়ার্ভ করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর সন্তান যদি কথা বলতে পারে, তার পেটে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করুন কোথায় ব্যথা হচ্ছে। সময় থাকতে তাকেও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।

মনে রাখবেন, পেটের ভিতরেই শরীরের বেশির ভাগ অরগ্যান থাকে। তাই নিজে থেকেই রোগ ভেবে নেবেন না। দীর্ঘ দিন পেটের ব্যথা অনুভব করলে শীঘ্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সময় থাকতে রোগ নির্ণয় করা গেলে তা সারবেও তাড়াতাড়ি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement