বেশি বয়সে অনেকেই পেটের নানা সমস্যায় ভোগেন। কিছু ক্ষেত্রে তার পিছনে দায়ী ভ্রান্ত অভ্যেসও। সে সম্পর্কে জেনে নিন বিশদে। প্রতীকী ছবি।
বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষই হজমের সমস্যায় ভোগেন। খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। কিছু খেলেই পেট ভার ভার লাগে। গ্যাস-অ্যাসিডিটি যেন নিত্য সঙ্গী। এটি কি কোনও রোগের লক্ষণ? যদিও জেনারেল ফিজিশিয়ান সুবীর মণ্ডলের মতে, বিভিন্ন কারণে বয়সকালে এই সব সমস্যা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ভুল পদক্ষেপ করার ফলেও তা হতে পারে। কী ভাবে এই ধরনের সমস্যা কমানো যেতে পারে বা সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করলেন তিনি।
আমরা যখন খাই, তখন আমাদের মুখের লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালা খাবারের সঙ্গে মেশে এবং তা খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এই সময়ে ফিডব্যাক মেকানিজ়মে মানুষের মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হয়ে শরীরের অন্যান্য পাচক-অঙ্গকে এই প্রক্রিয়ার সঙ্কেত পাঠায়। তার ফলে প্রয়োজনীয় উৎসেচক নিঃসরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, যা খাদ্যনালিতে খাবার পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে তা হজমের প্রক্রিয়া চালু করে। ডা. মণ্ডল জানালেন, সুস্বাদু খাবার বেশি ক্ষণ চিবিয়ে খেলে হজমের প্রক্রিয়াটি উদ্দীপিত হওয়ার ফলে খাবার হজম হতে সুবিধে হয়। কিন্তু বিস্বাদ খাবারের ক্ষেত্রে লালাগ্রন্থির নিঃসরণ ভাল হয় না, যার কারণে খাবার ঠিকমতো পরিপাক না হওয়ার ফলে হজমের সমস্যা বাড়ে। বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে এমনিতেই সময়ের সঙ্গে চোয়ালের পেশির ক্ষমতা কমতে থাকে। ফলে অনেকেই দাঁত বা অন্যান্য সমস্যার কারণে ঠিকমতো চিবোতে পারেন না। তা ছাড়া বয়সের সঙ্গে জিভের স্বাদ কোরকগুলি ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে খাবারের স্বাদ তাঁরা সে ভাবে পান না। ফলে খাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে, ঠিকমতো না চিবানোর প্রভাব পড়ে হজমের উপরেও।
এ ছাড়া, লালাগ্রন্থি, পেট বা পিত্তনালি ঠিকমতো কাজ না করার ফলে এবং নিঃসরণের ক্ষমতা কমায় মানুষের মুখের ভিতর শুকনো থাকে। ডা. মণ্ডল বললেন, ‘‘বেশি বয়সে অনেকে জোগ্রেন সিনড্রোমে ভোগেন। এটা একটি অটোইমিউন ডিজ়িজ়, যার কারণে মুখের গ্রন্থিগুলি শুকিয়ে যায়। এ ছাড়া, যাঁরা ধূমপান, মদ্যপান করেন বা বহু দিন ধরে ডায়াবিটিস কিংবা কিডনির ওষুধ খাচ্ছেন, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্যেও মুখ শুকনো থাকার কারণে ভাল করে খাবার চিবোতে পারেন না। সেখান থেকেই শুরু হয় বদহজমের সমস্যা।’’ অনেকের ইসোফেগাসে খাবার নামার প্রক্রিয়া (পেরিস্টালসিস মুভমেন্ট) ঠিকমতো না হওয়ায় পর্যাপ্ত পুষ্টি হয় না। অন্য দিকে, অনেকের আবার অপ্রয়োজনে অ্যান্টাসিড খাওয়ার অভ্যেস স্বাভাবিক হজমের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে বলে জানালেন সুবীর মণ্ডল। বিশেষ করে যে দিন অতিমাত্রায় প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া হয়, সে দিন অ্যান্টাসিড একেবারেই খাওয়া উচিত নয় বলে তাঁর অভিমত। কারণ পেটের স্বাভাবিক অ্যাসিড মাত্রা ওই প্রোটিন হজম করতে সাহায্য করে। ওষুধ দিয়ে ওই প্রক্রিয়া অযথা থামাতে গেলে বাড়ে হজমের সমস্যা। খেয়াল করলে দেখবেন, দিদা-ঠাকুমারা তাই মাংস রাঁধলে, সে দিন চাটনি তৈরি করতেন।
তা ছাড়া, বেশি বয়সে অধিক কাজকর্ম, অটোইমিউন কারণে অনেক গ্রন্থিতে ফাইব্রোসিসের সমস্যা দেখা দেয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বদঅভ্যেস, কার্বোহাইড্রেট বেশি খাওয়া ইত্যাদি কারণে লালাগ্রন্থি, বিশেষ করে প্যানক্রিয়াসের ক্ষতি হয়। খাবার হজম না হওয়ার ফলে মানুষ গ্যাসট্রিক ফুলনেসে ভোগেন, চলতি কথায় আমরা একে বলি পেট ভার লাগছে। তার ফলে মানুষের খাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। মস্তিষ্কও শরীরকে খিদে পাওয়ার সঙ্কেত দেয় না। পুরো হজম না হওয়া অবস্থায় খাবার যখন ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছয়, সেখানেও বয়সের কারণে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেওয়ালে থাকা ভিলি-তে (ছোট চুলের মতো জিনিস যাতে রক্তনালি থাকে এবং তা খাবার থেকে পুষ্টি আহরণ করে) খাবার শোষিত হতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভিলি-র ক্ষয়জনিত কারণেও শোষণ ব্যাহত হয়।
স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষুদ্রান্ত্র পেরিয়ে খাবার পৌঁছয় বৃহদন্ত্রে। খাবার এই অংশে জমতে থাকে, যা পরবর্তীতে আমরা মল হিসেবে ত্যাগ করি। ডা. মণ্ডল জানালেন, ক্ষুদ্রান্ত্রে খাবার থেকে পুষ্টি শোষিত হওয়ার পরে, বৃহদন্ত্রে কেবলমাত্র জল শোষিত হয় খাবার থেকে। বয়সকালে পেশির চলাচল ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বৃহদন্ত্রে বেশি ক্ষণ খাবার থাকার ফলে বেশি জল শোষিত হওয়ার কারণে মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়ে। বুড়ো বয়সে মানুষের খাওয়া কমে যাওয়ার ফলে যে মল কম হয়, সেটা অনেকেই বোঝেন না। তা ছাড়া, ভ্রান্ত ধারণার কারণেও মানুষ পার্গেটিভ খেয়ে থাকেন বলে জানালেন সুবীর। তা ছাড়া বদহজমের কারণে পেটে খাবার জমে থাকার ফলে শরীর খারাপের ভয় পান তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রেই অহেতুক পার্গেটিভ ব্যবহার করে মানুষ। ফলে খাদ্য থেকে পুষ্টিদ্রব্য ঠিকমতো শোষণের পূর্বেই নির্গত হওয়ার ফলে ম্যালনিউট্রিশন বা অপুষ্টি বাড়ে।
এ ছাড়াও বেশি বয়সে যে সব মানুষ সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, তাঁদের এমনিতেই হজমের সমস্যা হয়ে থাকে। কারণ, খাওয়াদাওয়ার পরে চলাফেরার কারণে পেন্ডুলাম মুভমেন্টে খাবার নীচের দিকে নামে। কিন্তু যিনি শয্যাশায়ী তিনি চলাফেরা করতে পারেন না, ফলে এই প্রক্রিয়াটিও ব্যাহত হয়।
তাই ডা. মণ্ডলের মতে, সকলেরই বয়স অনুসারে ব্যালান্সড ডায়েট গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে কোন বয়সে কী কী খাবেন এবং কতটা খেতে পারেন তা জানতে। অযথা ভ্রান্ত ধারণা থেকে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এবং যাঁরা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন তাঁদের রাতে রুটির বদলে ভাত খাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি। যেহেতু ভাতে সলিউবল ফাইবার থাকে, তাই তা মলত্যাগে সাহায্য করে। আর বয়স্ক মানুষদের দু’বার মলত্যাগের অভ্যেস করা উচিত বলেই পরামর্শ তাঁর। তাতে খাবার থেকে কম জল শোষণের সময় কম পাবে শরীর, তাই পায়খানা নরম থাকবে। তাতে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যার অনেকটাই সুরাহা হবে। পার্গেটিভ থেকেও তিনি দূরে থাকতে পারবেন। এ ছাড়াও তাঁর মতে, বয়স্ক মানুষদের ডায়াবিটিস থাকলেও বডি মাস ইনডেক্স যদি যথাযথ থাকে, তা হলে খাবার নিয়ন্ত্রণ করার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, ম্যালনিউট্রিশনে শরীরের ক্ষতি হয় বেশি। বরং ইনসুলিন বা ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে।
তাই, অযথা ভাবনাচিন্তা না করে জীবনটাকে উপভোগ করলে শরীরও ভাল থাকবে।