Coronavirus

আইসিএমআর-এর রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেক

‘প্রত্যেকদিন যে হারে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তাতে কখনওই বলা যায় না যে লকডাউন করে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়েছে।’

Advertisement

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২০ ১৬:৪৬
Share:

লকডাউন করেও রোখা যায়নি সংক্রমণ। ছবি: এএফপি।

নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা তিন লক্ষ কুড়ি হাজার ছাড়িয়ে বিশ্বের মধ্যে চার নম্বরে উঠে এসেছে আমাদের দেশ। আইসিএমআর-এর রিপোর্ট বলছে, এখনও এদেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়নি, বিশ্বের নিরিখে মৃত্যুর হার নগণ্য। মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় এবং কার্ডিওথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার বাস্তবের সঙ্গে আইসিএমআরের তথ্যের ফারাক বিশ্লেষণ করলেন। শুনল আনন্দবাজার ডিজিটাল।

Advertisement

আইসিএমআর সম্প্রতি প্রায় এক কোটি ভারতীয়ের উপর সেরোলজিক্যাল সার্ভে করে জানিয়েছে যে কোভিড -৯ ভাইরাসের সংক্রমণ এখনও বিপজ্জনক সীমার নীচেই আছে। এদিকে সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে।আমরা কি সত্যিই নিরাপদ, নাকি বিপদ এখনও কাটেনি?

সুকুমার মুখোপাধ্যায়:আমার মতে, এদেশের মানুষ এখনও যথেষ্ট বিপদের মধ্যেই আছেন। প্রত্যেকদিন যে হারে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তাতে কখনওই বলা যায় না যে লকডাউন করে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়েছে। এখনও আমাদের যথেষ্ট সতর্কতা মেনে মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রেখে চলা উচিত, নইলে ভয়ঙ্কর ভাবে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।

Advertisement

কুণাল সরকার:এই সময় নানান তথ্য ভাণ্ডারের ফিরিস্তি না দিয়ে বাস্তবকে স্বীকার করে নিলে বেঁচে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা চলেছি উল্টো পথে। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে হয়তো আর একবার নমস্তে ট্রাম্প সাহেব বলে আমেরিকাকে পেরিয়ে যাব। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে সেরোলজিক্যাল সার্ভে করে (আইজি-জি পরীক্ষা) বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগের বিস্তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সেই কাজ শুরু করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এত বড় দেশে যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল তার অনেক খামতি আছে। এছাড়া আইজি-জি জানা গেলেই যে সঠিক চিকিৎসা করে রোগীকে সুস্থ করে দেওয়া যাবে তা তো নয়! তাহলে এই অতিমারিকে অনেক আগেই আটকে দেওয়া যেত। মোদ্দা কথাটা হল, কোভিড-১৯ সংক্রমণের নিরিখে এদেশের মানুষ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন।

আরও পড়ুন: করোনার ভয়ে অন্য রোগকে অবহেলা নয়, সুস্থ থাকতে মেনে চলুন এ সব নিয়ম​

সেরোলজিক্যাল সার্ভে ব্যাপারটা কী?

সুকুমার মুখোপাধ্যায়:শরীরে রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না দেখার জন্য রক্ত পরীক্ষার নামই সেরোলজিক্যাল টেস্ট। আইসিএমআর দেশের মোট ৭৫টি জেলায় সেরোলজি সার্ভে করে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর-এর গবেষণা পত্রিকা)-এ প্রকাশ করেছে যে, .৭৩ শতাংশ মানুষের শরীরে আইজি_জি অ্যান্টিবডি পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের দেশের অল্প সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি অসুস্থতার পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে।

প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্য়া বেড়েই চলেছে। ছবি: এপি।

কুণাল সরকার: অ্যান্টিবডি হল বিশেষ এক ধরনের প্রোটিন যা শরীরে কোনও জীবাণু প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিভিন্ন অ্যান্টিবডির মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী ইমিউনোগ্লোবিউলিন-জি বা আইজি-জি। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে এরাই আমাদের বাঁচায়। রক্ত পরীক্ষা করে আইজি-জি পাওয়া গেলে বোঝা যায়, সেই মানুষটি আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই রক্ত পরীক্ষা আরটিপিসিআর টেস্টের মতো সময়সাপেক্ষ ও জটিল নয়। তাই প্রাথমিক ভাবে এই টেস্ট করে রোগী শনাক্ত করা হয়। এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসকে আমরা চিনেছি মাস ছ’য়েক। এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু জানা বাকি আছে। আর তা জানলে এতদিনে তো নভেল করোনার নির্দিষ্ট ওষুধ তৈরি হয়ে যেত। শুধুমাত্র আইজি_জি পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে আত্মতুষ্টি হলে ভবিষ্যতে বিপদের ঝুঁকি থেকেই যায়। ইটালি, ইউকে, জার্মানি, বার্মিংহামের মতো কয়েকটি দেশে আইজি-জি বেসড স্টাডি করে যে রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল, বাস্তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারের সঙ্গে তার বিস্তর তফাৎ ছিল। তাই ওদের দেখে আমাদের এই শিক্ষা নেওয়া উচিত যে শুধুমাত্র আইজি-জি স্টাডির উপর ভিত্তি করে আমরা নিরাপদে আছি, এই আত্মতুষ্টিতে ভুগলে তার ফল পেতে হবে লক্ষ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে।

আইসিএমআর-এর বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের দেশ এখনও গোষ্ঠী সংক্রমণের থেকে দূরে আছে।তা কি সত্যি নয়?

সুকুমার মুখোপাধ্যায়: আইসিএমআর সম্প্রতি এক সেরোলজিক্যাল সার্ভে করে জানিয়েছে, আমাদের দেশে এখনও গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়নি। কিন্তু একথা মানতে চাইছেন না এপিডেমিওলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে বেশ কয়েকটি বড় শহরে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে।

কুণাল সরকার: ভারতবর্ষ ৩২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশ। পুরো দেশে এক সঙ্গে গোষ্ঠী সংক্রমণ হতে গেলে ভাইরাস হাঁপিয়ে উঠবে। অঞ্চলভিত্তিক গোষ্ঠী সংক্রমণ যে শুরু হয়েছে তা গোপন করে লাভ কী! দুটো জিনিস চোখের সামনে দেখে সংক্রমণ কোন দিকে চলেছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এক, কত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন আর কতজন মারা যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে দিল্লির ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত। কিন্তু দিল্লির কোনও একটি ছোট জায়গায় সমীক্ষা করে যদি বলা হয় যে দিল্লিতে মোটে ১৫ শতাংশ মানুষের সংক্রমণ হয়েছে, সেই সমীক্ষার তো কোনও মানে হয় না। মুম্বই, গুজরাত, চেন্নাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু— সব জায়গাতেই রোগের বিস্তার ভয়ানক বেশি।এই সব জায়গায় গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি তা বলা বাতুলতা। এদের মধ্যে সব থেকে ভাল ভাবে কোভিড-১৯-এর মোকাবিলা করেছেনবেঙ্গালুরুর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যের বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবলেও পরে সেই আগুনের আঁচ আমাদের ঘরেও পৌঁছে যায়। কোভিড-১৯-এর ব্যাপারটাও ঠিক সেই দিকে যাচ্ছে। আগাম ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে, সত্যিই আমরা ভাইরাসকে আটকাতে সফল নাকি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে আছি।

আরও পড়ুন: রাজ্যে শুরু হয়েছে অ্যান্টিবডি টেস্ট, কতটা কাজে আসবে তা?​

তাহলে এখন আমাদের কী করণীয়?

কুণাল সরকার: নিজেদের সাবধান হতে হবে। আর সঠিক বিশেষজ্ঞদের হাতে এই অতিমারি পরিচালনার ভার দেওয়া দরকার এই মুহূর্ত থেকেই। দুঃখের ব্যাপার হল এই যে, আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের যে কাজের দায়িত্ব দেওয়ার কথা তা দেওয়া হয়েছে চেস্ট ফিজিশিয়ান, বায়োমেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ বা পেডিয়াট্রিশিয়ানদের। নিজের নিজের ক্ষেত্রে এঁরা এক একজন মহীরুহ হলেও জনস্বাস্থ্য বা এপিডেমিওলজি তাঁদের বিষয় নয়। অথচ তাঁদের হাতেই দেওয়া হয়েছে অতিমারি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব। ব্যাপারটা অনেকটা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাধ্যমিকের হাজারখানেক খাতা দেখার দায়িত্ব দেওয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমাদের দেশে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের আটটি কেন্দ্রে অজস্র জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আছেন যাঁরা এই কাজে পারদর্শী। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির মহামারি নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কোভিড-১৯-এর বাড়বাড়ন্ত আটকে দেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। সুদিনের অপেক্ষায় আজ তামাম ভারতবাসী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement