ছবি: পিটিআই।
চারিদিকে শুধু করোনা আর করোনা৷ প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ আজ এই দেশ তো কাল সেই দেশ৷ ঘুরে বেড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা, জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা৷ স্কুল-কলেজ-সিনেমা-থিয়েটারের দরজাও বন্ধহচ্ছে। দিনে পঞ্চাশবার হাত ধোব না মাস্ক পরব, তাই ভেবে দিশেহারা আমরা৷ উন্নত দেশগুলি যেভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু মিছিল কমাতে তৎপর হয়েছে, আমরা তা কতটা করতে পারব, তা নিয়ে চিন্তায় ঘুম নেই কারও৷
তাহলে?
তাহলে আসুন প্রথমে দেখা যাক, সারা বিশ্বে করোনার থাবা কতখানি বিস্তৃত ও কীভাবে তাঁরা লড়াই করছেন তার সঙ্গে৷ তারপর বিশেষজ্ঞের কাছে জেনে নেব তাকে ঠেকাতে ঠিক কী কী করতে হবে আমাদের৷
বিশ্ব মানচিত্রে
প্রথমে বলা যাক চিনের কথা৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২১ জানুযারি হুবেই প্রদেশে ১০০জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের খবর পাওয়া যায়৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যাটা হবে কম করে ১৫০০৷ কারণ যাঁরা রোগের কারণে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন তাঁদের সংখ্যাই কেবল এসেছে পরিসংখ্যানে৷ যাঁদের সদ্য সদ্য উপসর্গ দেখা দিয়েছে বা তখনও তেমনভাবে দেখা দেয়নি, তাঁদের সংখ্যা এই হিসেবে নেই৷ পরে তাঁরা যখন রোগ নিয়ে এসেছেন, তখন যখন জানতে চাওয়া হয়েছে, কত দিন ধরে উপসর্গ আছে, তাঁরা যে তারিখ বলেছেন, সেই হিসেব কষে এই সংখ্যা বেরিয়েছে৷ এর দু-দিন পর যখন দিন প্রতি প্রায় ৪০০ জন রোগীর সংখ্যা পাওয়া যেতে লাগলো, ইউহানের অধিবাসীদের গতিবিধি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে দেওয়া হল, তখন আসলে ইউহানে প্রতিদিন নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার, যা তখনও সরকারি তথ্যে স্থান পায়নি৷ এর দু’ দিন পর হুবেই প্রদেশের ১৫টি শহরে নাগরিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে দেওয়া হল৷তার দু-দিন পর রোগীর সংখ্যা বাড়ল, কারণ যাঁরা আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন অথচ উপসর্গ তেমন ছিল না বলে ডাক্তার দেখাননি, তাঁরা ডাক্তারের কাছে আসতে শুরু করলেন।কিন্তু নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করল৷ অর্থাৎ, রোগনির্ণয় ও চটজলদি চিকিৎসার পাশাপাশি গৃহবন্দি করার এই পদ্ধতিতেই হল মুশকিলআসান৷
হাত ধোওয়ার যে নিয়মের কথা বারবার বলা হচ্ছে, তা মেনে চলবেন৷
এবার একটু আমেরিকার দিকে তাকানো যাক৷ ধরা যাক ওয়াশিংটন স্টেট৷ তাকে এখন আমেরিকার ইউহান বলা হচ্ছে৷ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে৷ এই মুহূর্তে সরকারি মতে ১৪০ জন আক্রান্ত বলে জানানো হচ্ছে৷ মৃত্যুহার? দাঁড়ান, তাহলে একটা ঘটনার কথা বলা যাক৷ প্রথমদিকে জানা যায় মাত্র তিন জন এতে আক্রান্ত হয়েছেন৷ কিন্তু তারপর যেই একজন মারা গেলেন, কপালে ভাঁজ পড়ল বিশেষজ্ঞদের৷ মৃত্যুহার ৩৩ শতাংশ! সারা দুনিয়ায় যেখানে ০.৫ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে মৃত্যুহার, এখানে এত বেশি কেন?
সহজ কথা৷ যত জন আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন৷
তাহলে কতজন আসলে আক্রান্ত হয়েছেন তা কীভাবে জানা যাবে? শুরু হল বিরাট বিরাট হিসেব নিকেশ৷ তার একটু আভাস দেওয়া যাক৷
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সংক্রামিত হওয়ার পর মারা যেতে মোটামুটি ১৭.৩ দিন সময় লাগে৷ কাজেই ২৯ ফেব্রুয়ারি যিনি মারা গিয়েছেন তিনি সংক্রামিত হয়েছে ১২ তারিখ নাগাদ৷ মৃত্যুহার যদি এক শতাংশ ধরা হয়, তাহলে ১২ তারিখে মোটামুটি ১০০ জন আক্রান্ত ছিলেন৷ আরও নানা রকম হিসেবনিকেশ করে তাঁরা জানালেন, আজ একজনের মৃত্যু মানে আজকের দিনে অন্তত ৮০০ জন রোগী আছেন৷
ওয়াশিংটন স্টেটে মোট ২২ জন মারা গিয়েছেন৷ তার মধ্যে ১৯ জন যেহেতু এক এলাকার, হিসেবের সুবিধের জন্য তাঁদের এক ধরলে, মোট মারা গিয়েছেন ৪ জন৷ তাহলে রোগীর সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি হবে৷ আবার ট্রেভার বেডফোর্ড অ্যাপ্রোচ থেকে জানা যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার৷
মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তো? সরকারি সংখ্যা আর বাস্তব সংখ্যার মধ্যে ফারাক থাকে, সে আমরা সবাই জানি৷ কিন্তু সে ফারাক এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার কি কোনও দরকার আছে!
তা নেই৷ শুধু এটুকু জেনে রাখলেই হবে যে, যতই টিবি-তে বেশি রোগী মারা যান বা ফ্যাসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহার বেশি বলা হোক না কেন, করোনা-কে হালকাভাবে নেওয়ার কোনও অবকাশ নেই৷সতর্ক আপনাকে হতেই হবে৷
ভিড়ভাট্টা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-ফ্লাইটে চড়ার দরকার নেই৷
কীভাবে?
ভেবে দেখুন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন রোগের এত ছয়লাপ, জাপান, তাওয়াইন, সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড বা হংকংয়ে তার প্রকোপ তুলনায় কম কেন? কম, কারণ সময় থাকতে সতর্ক হয়েছে তারা৷ ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত হওয়ার পরই তারা বুঝে গিয়েছে এই রোগকে ঠেকানোর একমাত্র হাতিয়ার সতর্কতা৷
সতর্ক হোন
চিকিৎসক সুব্রত ভৌমিকের মতে, মৃত্যুমিছিল দেখে আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবনযাপন বন্ধ করবেন না৷ কারণ একটু চোখ খুললেই দেখতে পাবেন, যেখানে বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, হয় সেখানে বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেশি, ডায়াবেটিক, ক্যান্সার, কিডনির দূরারোগ্য অসুখ বা অন্য কোনও কারণে তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, নয়তো চিকিৎসা ব্যবস্থা যথাযথ নেই৷ কাজেই মোটামুটি সুস্থসবল কম বয়সি থেকে মাঝবয়সি বা প্রৌঢ় মানুষের সাধারণ সতর্কতার বাইরে আর বিশেষ কিছু করার নেই৷ যত দিন যাবে, স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের মধ্যে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হবে, যাকে বলে হার্ড ইমিউনিটি৷ বিপদ কমবে৷ তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়েও বিপদ কমবে৷ অতএব চিন্তা করবেন না৷ কয়েকটি নিয়ম শুধু মেনে চলুন৷ যেমন—
• কারও হাঁচি-সর্দি-কাশি জ্বর হলে তার থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করুন৷ সে শুধু এ রোগের জন্য নয়, ফ্লু প্রতিরোধেও এই একই নিয়ম৷
• নিজের হলে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে হাঁচবেন৷ কাশির সময় মুখে রুমাল চাপা দেবেন৷
• হাত ধোওয়ার যে নিয়মের কথা বারবার বলা হচ্ছে, তা মেনে চলবেন৷
• দু-দিনের মধ্যে কষ্ট না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন৷
বয়স বেশি হলে বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে কি তবে গৃহবন্দি থাকার নিদান?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সব্যসাচী সেন জানিয়েছেন, ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়৷ অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষের এমনিতেই একটু বিশ্রামে থাকা দরকার৷ এই সময় এই ভাইরাস ছাড়া অন্যান্য ভাইরাসও একটু বেশি সক্রিয় থাকে৷ তাদের হাত এড়িয়ে বাঁচতে গেলে কয়েকটি নিয়ম মানতে হবে৷ যেমন—
• ঘরে বা খোলামেলা জায়গায় বসবাস করাই ভাল৷
• ভিড়ভাট্টা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে৷ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-ফ্লাইটে চড়ার দরকার নেই৷
• ভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর যে যে নিয়ম আছে, সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে৷
• জ্বর-সর্দি-কাশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে৷
• খাওয়া-ঘুমের নিয়ম মেনে চলতে হবে যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক থাকে৷