ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
বছরের শুরুতেই ক্যালেন্ডার দেখে লাফিয়ে উঠেছিলেন সৌমাভ। সুদূর কানাডা থেকে ফোন করে চন্দ্রাবলীর ঘুম ভাঙিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ বার দু’দিন ভ্যালেন্টাইন’স ডে। একসঙ্গে কাটাব। কলকাতায় আসছি।’’
তখন কলেজবেলা। এক সরস্বতী পুজোর সকালে সৌমাভ চন্দ্রাবলীকে বলেছিল, ‘‘আমার সঙ্গে হাঁটবি সারা জীবন?’’ কোনও কথা বলেনি চন্দ্রাবলী। দিন কয়েক পরে ভ্যালেন্টাইন’স ডে। সৌমাভর ফের প্রশ্ন, ‘‘তুই তো কিছু বললি না!’’ এ বার উত্তর দিয়েছিল চন্দ্রাবলী। শঙ্খ ঘোষের কথা ধার করে বলেছিল, ‘‘বলিনি কখনও/আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে...’’
সেই শুরু একসঙ্গে পথ চলা। তার পরে কেটেছে দশ-দশটা বছর। গবেষণা করতে সৌমাভ এখন কানাডায়। চন্দ্রাবলী কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। তবু আজও তাঁদের কাছে গুরুত্ব কমেনি এই দুটো দিনের।
বাঙালির কাছে বরাবরই প্রেমের দিন দুটো। একটা ‘সরকারি’ মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন’স ডে। আর একটা রীতিমতো বেসরকারি অথচ অমোঘ— সরস্বতী পুজো। এ বছর এ বছর যা ১৩ ফেব্রুয়ারি। পরপর দুটো দিন পেয়ে তরুণ প্রজন্মের খুশি তুঙ্গে।
তবে প্রেমের দিন উদ্যাপন নিয়ে কলকাতা স্পষ্টতই তিন ভাগ। প্রথম দলের উন্মাদনা সরস্বতী পুজো ঘিরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্রীতমা সেন বা প্রেসিডেন্সির ছাত্র প্রান্তিক বসু জানালেন, ভ্যালেন্টাইন’স ডে নিয়ে কোনও দিনই খুব উৎসাহ ছিল না। বরং সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকতেন সরস্বতী পুজোর জন্য। প্রথম প্রেমও এসেছিল এই দিনটির সূত্রেই। এখনও প্রতি বছর সরস্বতী পুজোয় স্কুলে যান। প্রান্তিকের মতে যারা মফস্সলে বড় হয়েছে, তাদের কাছে সরস্বতী পুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা। সে দিনই তো প্রিয় বান্ধবীকে প্রথম বাসন্তীরঙা শাড়ি পরতে দেখা। তুলনায় ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর জৌলুস বরং অনেকটাই কম। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে নেই। বসন্তপঞ্চমী আছে।’’
অন্য দলটির কাছে আবার ভ্যালেন্টাইন’স ডে বড্ড স্পেশ্যাল। স্কটিশ চার্চ কলেজের সোহিনী, নন্দিনী এবং যাদবপুরের অন্বেষা, সুকন্যা, ব্রতজিৎ ও স্বস্তিক সেই স্কুলবেলা থেকেই বন্ধু। তাঁরা জানালেন, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর জন্য বছরের শুরু থেকেই প্ল্যানিং শুরু হয়ে যায়। ভালবাসার মানুষটাকে পছন্দের উপহারে চমকে দিতে এটাই তো আদর্শ দিন। ‘‘এই দিনে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করি,’’ বলছেন তাঁরা।
খড়্গপুর আইআইটি-র গবেষক তীর্থঙ্কর সরকার বা সদ্য চাকরি করতে ঢোকা সুয়াভো মুখোপাধ্যায় আবার সরস্বতী পুজো বনাম ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর এই বরাবরের লড়াইয়ে ঢুকতে নারাজ। তাঁরা বেশি আনন্দিত এই দুটো দিন শনি আর রবি হওয়াতে। তীর্থঙ্কররা পাঁচ বন্ধু মিলে শুক্রবার বিকেলেই রওনা দিচ্ছেন মন্দারমণি। আর সুয়াভোর দাবি, এই হানাহানি, মারামারির পৃথিবীতে যদি পরপর দুটো দিন প্রেমের জন্য বরাদ্দ হয় তো মন্দ কী? তিনি আরও বলছেন, ‘‘যে সব উদারহৃদয় মানুষের প্রেমিক বা প্রেমিকার সংখ্যা একের বেশি, তাঁদের পক্ষে তো দুটো দিন ভালই।’’
তবে গুরুত্ব নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, সরস্বতী পুজো হোক বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে— প্রেমের দিন উদ্যাপনের ধরন যে অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে তা মানছেন সকলেই। তাঁদের মতে, প্রেমের প্রকাশটাই পাল্টে গিয়েছে। তাই এ দু’টি দিনে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুয়াভো বলছেন, ‘‘নিভৃত জায়গা কমেছে, তাই গোপনীয়তার আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্রেম। কলকাতা শহরে এখন নির্ভাবনায় প্রিয় মানুষটির হাত ধরা যায়।’’ অন্বেষা, ব্রতজিৎরা জানাচ্ছেন, এখন পার্ক বা প্রিন্সেপ ঘাটের বদলে কলকাতার তরুণ প্রজন্ম শপিং মলে ‘ডেট’-এই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।
এখনকার ছেলে-মেয়েদের এই সহজ মেলামেশা নিয়ে আশাবাদী সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ফ্রি-মিক্সিং ভাল জিনিস। তাতে জড়তা কাটে। তবে কোথাও একটু দূরত্ব থাকাও ভাল। সরস্বতী পুজো আর ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে এক করে দেখতে নারাজ শীর্ষেন্দুবাবু বলছেন, ‘‘প্রেমের দিন কথাটাকে আমরা অনেক বেশি সরল করে ফেলেছি। নিছক নর-নারীর প্রেম হিসেবে না দেখে মহৎ কোনও প্রেমের কথা ভাবলে সকলের মঙ্গল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সরস্বতী তো প্রেমের দেবী নন। তাছাড়া পুজোর মধ্যে একটা সংযমের ধারণা লুকিয়ে আছে। এর সঙ্গে অন্য কিছুকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।’’
পাল্টে যাওয়া প্রেমকে স্বাগত জানাচ্ছেন নাট্যকার ব্রাত্য বসুও। তাঁর মতে, এতে প্রেমের পরিসর বাড়ছে। তবে কোনও বিশেষ দিনকে প্রেমের দিন বলতে তাঁর আপত্তি আছে বলে জানান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘জীবনে প্রেম থাকলেই হল। কোনও বিশেষ দিনেই পালন করতে হবে, তার মানে নেই।’’
কবি শ্রীজাতও ভ্যালেন্টাইন’স ডে আর সরস্বতী পুজোকে এক করে দেখতে রাজি নন। জানালেন, প্রেমের জন্য কোনও বিশেষ দিনের কথা কখনওই ভাবেননি। বরং সারাটা বছর ধরে উদ্যাপিত হতো প্রেম। তবে সরস্বতী পুজোর দিনটা ছিল ভীষণ অন্য রকম। প্রচুর চিঠি আদান-প্রদান হতো ওই দিন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম শাড়ি পরে এই দিনেই চেনা বান্ধবী প্রথম বার অচেনা নারী হয়ে উঠত। সরস্বতী পুজো তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আমার জীবনে।’’ শ্রীজাত আরও বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে প্রেমের ধরন পাল্টাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুভূতিটা আজ থেকে হাজার বছর পরেও একই রকম থেকে যাবে।’’
দেখুন এই সংক্রান্ত গ্যালারি...
থিমের ছোঁয়া সরস্বতী পুজোয়