Cervical Cancer

সারভাইক্যাল রোধ সুরক্ষার ভাবনায়

পরিবারের অপরিণামদর্শিতা কোনও মেয়েকে কখনও রোগভোগের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু সচেতনতায় ঠেকানো যায় মারণ রোগও। নতুন বছরের প্রথম মাস আন্তর্জাতিক এক স্বাস্থ্য সংস্থা সারভাইক্যাল ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসাবে পালন করেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ক্যানসার বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এই আবহে সারভাইক্যাল ক্যানসারের কারণ ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করলেন সুশোভন ঘোষ আশার বিষয় হল, এই সারভাইক্যাল ক্যানসার ১০০ শতাংশ প্রতিরোধ যোগ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৩৩
Share:

আশ্বাস: সারভাইক্যাল ক্যানসার নিয়ে প্রচার। ছবি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সৌজন্যে

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি যে ক্যানসারে মহিলারা আক্রান্ত হন তার মধ্যে দ্বিতীয়টি হল জরায়ু মুখের ক্যানসার। বা সারভাইক্যাল ক্যানসার। ভারতে ২০১৮ সালে ৯৬ হাজার ৯২২ জন মহিলা এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন ৬০ হাজার ৭৮ জন। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটি আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ আমাদের দেশে একটা বড় সংখ্যায় রোগ বা মৃত্যু পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তে প্রতি দু’মিনিটে একজন মহিলা সারভাইক্যাল ক্যানসারে মারা যান।

Advertisement

আশার বিষয় হল, এই সারভাইক্যাল ক্যানসার ১০০ শতাংশ প্রতিরোধ যোগ্য। এর জন্য দরকার সচেতনতা, সঠিক সময়ে পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

কেন হয় এই ক্যানসার

Advertisement

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) সংক্রমণ এই ক্যানসারের প্রধান কারণ। প্রায় ১০০ প্রজাতির এইচপিভি ভাইরাস রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮ ভাইরাস দু’টো ক্যানসারের জন্য দায়ী থাকে।

সংক্রমণ কী ভাবে ঘটে

যৌন মিলনের সময় এই ভাইরাসগুলো জরায়ুমুখ বা সারভিক্সে সংক্রমণ ঘটায়।

সব সংক্রমণে কি ক্যানসার হয়

এর উত্তর, না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনাআপনি এই সংক্রমণ শরীর থেকে অপসারিত (স্পনটেনিয়াস এলিমিনেশন) হয়ে যায়। যাঁদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ বেশ কয়েক বছর থেকে যায় তাঁদের ‘ক্রনিক ইনফেকশন’ বলা হয়। এই ক্রনিক ইনফেকশনের মাত্র দুই শতাংশ ক্যানসারে পরিণত হতে পারে। সাধারণত এইচপিভি সংক্রমণ থেকে ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দেওয়া পর্যন্ত প্রায় ১০-২০ বছর সময় লাগে।

কাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি

১। কম বয়সে বিয়ে দেওয়া বা নাবালিকা বিবাহ।

২। কম বয়সে প্রথম সন্তান ধারণ বা কম বয়সে প্রথম যৌন মিলন।

৩। বহুগামিতা বা একাধিক যৌনসঙ্গী এবং অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ করলে।

৪। তিন বা তার বেশি সন্তান প্রসব করলে।

৫। অপুষ্টি থাকলে বা ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতার কারণে এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

সংক্রমণ থেকে লক্ষণ পর্ব

এই সময়কালকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘প্রি ক্যানসারাস পিরিয়ড’ বলে। এই সময়কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়কালের মধ্যে পরীক্ষা করে বোঝা যায় ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। আর যদি থাকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা করালে ক্যানসার হওয়া আটকানো যায়। মৃত্যুর হারও কমে। রোগভোগ এবং পরিবারের অর্থ ব্যয়ও কম হয়।

ক্যানসার সম্ভাবনা জানার কী কী পরীক্ষা রয়েছে

কতকগুলো পরীক্ষা রয়েছে। যেগুলো সারভাইক্যাল স্ক্রিনিং টেস্ট নামে পরিচিত। এর মধ্যে পিএপি স্মিয়ার টেস্ট ও ভিআইএ (ভিসুয়াল ইনস্পেকশন উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড টেস্ট) সবচেয়ে সহজ, উপযোগী এবং কম খরচ সাপেক্ষ পরীক্ষা।

কোথায় হয় পরীক্ষা

সরকারি হাসপাতাল যেখানে স্ত্রী রোগ এবং প্যাথলজি বিভাগ আছে সেখানেই হয়। বেসরকারি ল্যাবরেটরিতেও হয়। খরচও বেশি নয়। মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। ব্যথা লাগা বা রক্তপাত হয় না। জরায়ুমুখের রস নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

কাদের দরকার এই পরীক্ষা

৩০ বছরের পর প্রতিটি মহিলার এই পরীক্ষা করা দরকার। প্রতি তিন বছর অন্তর। যতদিন না মাসিক রক্তস্রাব বন্ধ হচ্ছে।

পরীক্ষার ফলের পরে করণীয়

পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক হলে আবার তিন বছর পর পরীক্ষাটি করা হয়। অস্বাভাবিক হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মত পরবর্তী পরীক্ষা এবং চিকিৎসা করানো দরকার। এতে ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়া আটকে দেওয়া যায়।

সারভাইক্যাল ক্যানসারের লক্ষণ

১। অনিয়মিত রক্তস্রাব, বেশি রক্তস্রাব।

২। সহবাসের পর রক্তস্রাব।

৩। কোনও ভারী কাজ করলে বা ভারী জিনিস তোলার পর রক্তস্রাব।

৪। কয়েক বছর মাসিক রক্তস্রাব বন্ধ থাকার পর আবার রক্তস্রাব শুরু হওয়া (পোস্ট মেনোপজ ব্লিডিং)।

৫। অত্যধিক ও অস্বাভাবিক সাদাস্রাব।

এই সব লক্ষণের সঙ্গেই ক্যানসারের সাধারণ উপসর্গ যেমন খেতে না পারা, ওজন কমে যাওয়া, রক্তাল্পতা, এই সব থাকে।

ক্যানসার ধরা পড়ার পরে চিকিৎসা

১। একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অপারেশন অথবা রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি করা।

২। পরবর্তী পর্যায়ে ধরা পড়লে রেডিয়েশন, কেমোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

বেশির ভাগ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে এই চিকিৎসা পাওয়া যায়।

কী ভাবে প্রতিরোধ সম্ভব

১। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দেওয়া। নাবালিকা বিবাহ বন্ধ করা। মেয়েদের সুরক্ষিত যৌন মিলনের শিক্ষা দেওয়া। একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করা। সবসময় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের দিকে মেয়েদের নজর দেওয়া।

২। টিকাকরণ— ৯-১৩ বছরের বালিকাদের প্রতিষেধক দেওয়া যায়। সাধারণত প্রথম যৌন মিলনের আগে এই প্রতিষেধক দেওয়া দরকার। ছ’মাসের ব্যবধানে দু’টি ডোজে এই প্রতিষেধক দেওয়া হয়।

৩। ৩০ বছরের পর থেকে প্রতি তিন বছর অন্তর পিএপি টেস্ট বা ভিআইএ করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

৪। সারভাইক্যাল ক্যানসারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে কোনও সময় এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া।

সচেতনতা, সঠিক পরীক্ষা ও ঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে সারভাইক্যাল ক্যানসার এবং রোগের কারণে মৃত্যু, দু’টোই আটকে দেওয়া যায়।

লেখক নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement