—প্রতীকী চিত্র।
পয়লা বৈশাখ কোনও চিরাচরিত বাঙালি ঐতিহ্য নয়। আলু বা টম্যাটোর মতো ইউরোপীয়দের অবদান, আপাতত ঝালেঝোলে বিরিয়ানিতে রমণার বটমূলে এ পারে, বাংলাদেশে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। উৎসবটা যে কলকাতায় নতুন, রাধাপ্রসাদ গুপ্তের মতো পণ্ডিত এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কবি তার প্রমাণ। দু’জনের কেউই আজ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু প্রায় এক কথা লিখে রেখে গিয়েছেন। তাঁদের ছোটবেলায় শহরে পয়লা বৈশাখের এহেন রমরমা ছিল না। ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা প্রতিভা বসু আবার তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলছবি’তে উল্টো কথা লিখেছেন। এ দিন তাঁর বাবা নতুন পোশাক কিনে দিতেন, বাজার থেকে ভাল বাখরখানি নিয়ে আসতেন। নববর্ষ পালনের আনন্দে, উল্লাসে সে দিন থেকেই কি ঢাকা শহর কলকাতাকে হারিয়ে দিচ্ছিল?
যাক, ঢাকা বনাম কলকাতা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। সব ঐতিহ্যই সময়ের ফেরফারে তৈরি হয়। দিন কয়েক বাদে, অক্ষয়তৃতীয়া থেকে চারধাম সফর শুরু হবে। অনেক বাঙালি ট্রেনে, বাসে উত্তরাখণ্ডের কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী দর্শনে যাবেন। অথচ, প্রাচীন চার ধাম অন্য। কেদার, দ্বারকা, পুরী ও দক্ষিণে রামেশ্বরম। ট্রেনে, বাসে অন্য জাতের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাতায়াত নৈব নৈব চ। বাঙালি তখন ছড়া কাটত, ‘জাত মারলে তিন সেনে/কেশব সেনে, উইলসনে আর ইস্টিশনে।’ এখন ট্রেনে কাশী, গয়া, মথুরা, বৃন্দাবন যেখানে যান না কেন, কেউ আপত্তি করবে না।
ট্রেন খুব গুরুত্বপূর্ণ, পয়লা বৈশাখের সঙ্গে একটা সম্পর্কও আছে। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র তাঁর এক নিবন্ধে পয়লা বৈশাখের হরেক পুরনো পঞ্জিকার কথা বলেছিলেন। সেখানে তিনি দেখান ১৮৩০-৪০ থেকেই পঞ্জিকায় বিভিন্ন ট্যাক্সের রেট, আদালতি স্ট্যাম্পের দাম, কোন তীর্থে কোথায় ধর্মশালা ইত্যাদি আছে। লাটের খাজনা দাখিলের শেষ তারিখ, মাসিক কৃষিকাজের বিবরণ, টাকার বিনিময় হার ইত্যাদিও থাকত পাঠকের সুবিধার্থে। ১৮৭৫-৭৬ সালে শ্রীরামপুরের মাধবচন্দ্র সিদ্ধান্তের পঞ্জিকার উদাহরণ দিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ, সেখানে প্রতি পাতায় মুসলমানি চান্দ্রমাস ও ক্ষণ লেখা, বৈষ্ণব, শাক্ত, মুসলমান আর খ্রিস্টান পর্বের দিনক্ষণ পরস্পর সন্নিবেশিত। আজও পয়লা বৈশাখ সে রকমই সকলের উৎসব। তবে আধুনিক ‘সেকুলার’ বাঙালিরও গোলমাল আছে। পঞ্জিকার মূল কথাটা কী? কৈলাস পর্বতে উমা বর্ষফল জানতে চাইছেন, শিব এ বার তাঁকে নানা কথা জানাচ্ছেন। পাঁজিতে এই ভাবেই হিন্দু, মুসলমান, নানা তিথি-তথ্য ও কৃত্যকর্ম ঢুকেছে। সেকুলার শব্দটির অর্থ ধর্মহীনতা। হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় বা টানাপড়েনকে নতুন শব্দ ‘সেকুলারিজ়ম’ দিয়ে যে ব্যাখ্যা করা যায় না।
বরোদায় অরবিন্দ ঘোষকে যিনি বাংলা শেখাতেন, সেই দীনেন্দ্রকুমার রায় নদিয়া জেলায় তাঁদের গ্রামে পয়লা বৈশাখ প্রসঙ্গে চমৎকার লিখেছিলেন, ‘দৈবজ্ঞ শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় দর্শন দিলেন। তিনি আজ অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়ী বাড়়ী ঘুরিয়া সংবৎসরের শুভাশুভ বার্তা শুনাইয়া বেড়াইত্ছেন, আজ তাঁহার বিন্দুমাত্র অবসর নাই… তিনি একখানি টুলের ওপর বসিয়া বহু পুরাতন সূত্রবদ্ধ শ্রীহীন চশমাজোড়াটি চোখে দিয়া পুঁথি খুলিলেন এং গম্ভার মুখে বিদ্যার জাহাজ নামাইয়া সুর করিয়া সংস্কৃত শ্লোক পড়িয়া তাহার ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন, ‘অর্থাৎ এ বৎসর ব্যারাম-স্যারাম খুব বেশী হবে, ধান্যের অবস্থা ভাল নয়, বৃষ্টি অল্প। তাঁহার এই সকল অশুভসূচক দৈববাণী শুনিয়া গৃহিণীগণ অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, অবশেষে আচায্যি ঠাকুর তাঁহাদের মনস্তুষ্টির জন্য ও কিঞ্চিৎ লাভের আশায় যখন বলিলেন, তা তোমাদের গ্রহ এ বার বেশ প্রসন্ন, শুক্র স্থানে শনি আছে, সংবৎসর বেশ ভালই যাবে, তবে অসুখবিসুখের জন্য মাঝেমধ্যে এক-আধটা শান্তিস্বস্ত্যয়নের দরার হবে, কোন ভয় নাই’, তখন তাঁহারা প্রফুল্ল মনে যথাসাধ্য দক্ষিণা দিয়া দৈবজ্ঞকে বিদায় করিলেন।’ উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ, কিন্তু ছাপা পাঁজির আগে এ ভাবেই নতুন বাংলা বছর পালিত হত। দৈবজ্ঞ তুলট কাগজে লেখা পুঁথি হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বে়ড়াতেন। এখন কলেজ স্ট্রিটেও যাওয়ার দরকার নেই, রোজকার খবরের কাগজের হকারকে বললেই সে বাড়ি বয়ে দিয়ে যাবে। গৌতমবাবু উনিশ শতকের এক পঞ্জিকার অলঙ্করণে দেখিয়েছিলেন, হর-পার্বতী কৈলাসে, পাশেই দোতলা দালানকোঠা। জনসমাজে দোতলা-তিনতলা বাড়ি তখন থেকেই আকর্ষণীয়, ভরসাযোগ্য। এখন সিন্ডিকেটরাজ, কে কবে ধসবে, ইয়ত্তা নেই। শুধু মৃতে ত্রিপাদদোষ-টোষ নয়, বাঙালি জনসমাজে আরও অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয় নববর্ষের পঞ্জিকা।
বাঙালির পুজো-আচ্চার দিন, তিথি, নক্ষত্র জানায় যাঁরা আজও অন্যতম ভরসা, কথা হচ্ছিল সেই গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অরিজিৎ রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, পঞ্জিকার বিক্রি ফি বছর বেড়েই চলেছে, নতুন ১৪৩১-ও ব্যতিক্রম নয়। প্রথমত, বছর বছর পুজোর সংখ্যা ও তার রকমফের বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, পঞ্জিকায় পরের বছরের বিয়ের তারিখও থাকে। ফলে দেশে তো বটেই, অনাবাসীদের বিয়ের পরিকল্পনায় পঞ্জিকা রীতিমতো সাহায্যকারী। তিন নম্বর, করোনার সময় থেকে তাঁরা সফ্ট কপি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিক্রি করেন। কলেজ স্ট্রিটে বাংলা বইয়ের বিক্রি কমে যাওয়ার কাঁদুনির পাশাপাশি এই পঞ্জিকা-সত্য আজও বিদ্যমান। লিভ ইনের বাড়বাড়ন্ত সময়েও এত পঞ্জিকা, বলে বিস্ময় প্রকাশ করায় তিনি হেসে ফেললেন, ‘দুর! সে আর কতজন?’ আরও বললেন, ‘সোনার দোকান দেখেন না? কোন দোকানে গ্রহরত্ন বিক্রি হয় না? কোন দোকানে জ্যোতিষী বসেন না?’ বুঝলাম, ধনতেরাসের বিক্রিবাটার বাইরেও জনসমাজে অনেক হিরে-মুক্তো ছড়িয়ে, আমাদের ছানি পড়া সবজান্তা চোখে সে সব ধরা পড়ে না।
রাষ্ট্রের হুকুমদারি নয়, এই নববর্ষ-উৎসব ইংরেজের দেখাদেখি বাঙালি আমজনতার সৃষ্ট। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে খাজনার হিসাবের সুবিধার জন্য বঙ্গাব্দ শুরু হয়, কিন্তু পয়লা বৈশাখ তখনও বাঙালির খাবারদাবার, পোশাকআসাক ও পান্তা ভাতের উৎসব হয়নি। ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত তাঁর সাম্প্রতিক ‘হেঁশেলদর্পণ’ বইয়ে জানিয়েছেন, সেই সময়ে ঝিঙেশাল, রামশাল, কনকপানি, পদ্মজাল, রাধাতিলক, রাধুনিপাগল, কাটারিভোগ ইত্যাদি নানা রকম চাল হত। তাঁর সিদ্ধান্ত, সে সময়ে ঘরে ঘরে রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোআভেন কিছুই ঢোকেনি, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই লোকে পান্তা খেত। সেটিকেই ‘ঐতিহ্য’ ভাবলে ভুল হবে। তখন গ্রামসমাজ মুখ্যত কৃষিজীবী। চড়ক, পৌষপার্বণ, নবান্ন এ সবই প্রধান উৎসব। ঔপনিবেশিক জমানায় দেখা গেল, পয়লা জানুয়ারি বচ্ছরকার প্রথম ছুটি। নব্য বাঙালি ভাবল, তা হলে আমরাই বা নই কেন? অতএব, পয়লা বৈশাখ প্রথম থেকেই খোঁড়া পায়ে দৌড়েছে। গ্রামবাংলার নবান্ন বা পৌষসংক্রান্তির মতো জনপ্রিয়তা তার নেই, আবার ব্রিটিশ শাসকদের বড়দিন, নিউ ইয়ার্স ইভের মতো গ্ল্যামারও নেই। আজও বাংলার কোনও কোনও গ্রামে পয়লা বৈশাখকে ‘বাসি চড়ক’ বলে। এমনিতে বাংলার অনেক মন্দিরের গায়ে চড়কের ছবি পাওয়া গিয়েছে, পয়লা বৈশাখের আনন্দ উৎসবের নয়। প্রথম দিকের ছাপা পঞ্জিকা ও পুঁথিতে চড়ক উৎসব বা দুর্গাপুজোর পাতাজোড়া ছবি থাকত, পয়লা বৈশাখের নয়। হুতোম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সকলেই তথৈবচ। ইংরেজি নববর্ষ, চড়কের মেলা নিয়েই তাঁদের নকশা ও ছড়া।
স্বাধীনতার পরও ব্যাপারটা বিশেষ বদলায়নি। অফিসের লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখে এলাম ১৯৭৫ সালের পয়লা বৈশাখের কাগজ। কোনও ক্রোড়পত্র নেই, শুধু ‘হিমদ্রি পাখা’, ‘এমব্যাসী হোটেল’ (তখন এই বানান লেখা হত) ইত্যাদি গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী শুভেচ্ছা, আর বাংলা ১৩৮২ সাল কেমন যাবে, তা নিয়ে একটি নিবন্ধ। বিজ্ঞাপনদাতা থেকে পাঠকপাঠিকা, মিডিয়া কেউই দিনটাকে ধর্তব্যে আনেননি। বালক বয়সের স্মৃতি মনে পড়ছে, বিকেলে বাবার হাত ধরে মাসকাবারি দোকানে যেতাম। বাক্সে শুকনো নিমকি, কিছু মিষ্টি ও একটি বাংলা ক্যালেন্ডার দিতেন সেই দোকানি কাকুরা। মাসকাবারি কাকু, জেঠুদের দোকান আর নেই। সারা বছর কেনাকেনি সত্ত্বেও সুইগি ইনস্টামার্ট বা ব্লিঙ্কিট কোনও আত্মীয়তার উপহারে বাঁধে না। নাকি এটাই নতুন সভ্যতার রকমফের? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে বেণীমাধব শীলের নতুন বছরের পঞ্জিকা খুলি। আফটার অল, হাতে পাঁজি রবিবার!
দেখলাম, আগামী কাল নববর্ষে যাত্রা নাই, শুভকর্ম নাই। পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি থানার ত্রিকূলগ্রামে ১৪ হাত উঁচু মা কালীর মূর্তি গড়ে শুরু হচ্ছে তিন দিনের মেলা। কলকাতায় অবশ্য পয়লা বৈশাখ মানে সকালে কালীঘাটে হালখাতা, বিকেলে কলেজ স্ট্রিটে প্রকাশকের দফতর। দ্বিতীয়টি বেশ ম্রিয়মাণ, পয়লা বৈশাখের বদলে এখন বইমেলাতেই যাবতীয় নতুন বই। চিরাচরিত বলে কিছু হয় না, পুরনোর বদলে নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এটাই সমাজের দস্তুর, পয়লা বৈশাখের শিক্ষা।