রাস্তার ধারের চক্ষু চিকিৎসা শিবিরে যে ধরনের সংক্রমণের কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, এ বার কার্যত তেমন সংক্রমণের হদিস মিলল খাস কলকাতার এক নামী সরকারি হাসপাতালে। সংক্রমণের শিকার আট জন। তিন জনের চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের।
চোখের ঝাপসা হয়ে যাওয়া দৃষ্টি স্পষ্ট করতে সরকারি আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছানি কাটাতে এসেছিলেন ওঁরা। কিন্তু দৃষ্টি স্পষ্ট তো হলই না, উপরন্তু চোখটাই হারাতে বসলেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, গত ২৯ এপ্রিল আরজিকরে পরপর কয়েক জনের ছানি কাটানো হয়। পরদিন থেকে চোখে প্রচণ্ড জ্বালা, জল পড়া শুরু হয় তাঁদের অনেকেরই। অভিযোগ, ৩০ তারিখ ধর্মঘটের দিন হাসপাতালে তাঁদের সমস্যা জানানোর মতো কাউকেই পাননি রোগীরা। ১মে ছুটির দিনেও কার্যত একই অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে শনিবার তাঁরা সমস্যার কথা জানানোর সুযোগ পান।
গভীর সংক্রমণের শিকার তিন জনকে রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজিতে (আরআইও) পাঠানো হয়েছে। বাকি পাঁচ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে। অস্ত্রোপচারের সময়ে ব্যবহৃত রিংগার ল্যাককেট দ্রবণ বা জীবাণুমুক্ত না করা কোনও সরঞ্জাম থেকে ওই সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকদের অনুমান। তবে এখনও সংক্রমণের উৎস সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেহেতু একাধিক রোগী এই সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাই চিকিৎসকেরা নিশ্চিত তা ছড়িয়েছে হাসপাতাল থেকেই।
বিভিন্ন ক্লাব এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই যত্রতত্র ছানি কাটানোর শিবির করায় এমন নজির বিরল নয়। এর আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চোখ খুইয়েছেন অনেকে। তা থেকে শিক্ষা নিয়েই ওই ধরনের ক্যাম্পে অস্ত্রোপচার নিষিদ্ধ করেছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রক। বলা হয়েছিল, অপারেশন থিয়েটার থাকলে তবেই অস্ত্রোপচার করা যাবে। কিন্তু খাস সরকারি হাসপাতালেই ছানি অস্ত্রোপচারে এমন ঘটনা ঘটার পরে সাধারণ মানুষ কীসের উপরে ভরসা রাখবেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
চোখে সংক্রমণ হওয়া রোগীদের পরিবারের লোকেরা অনেকেই এ দিন আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ দেখান। আরজিকরে চক্ষু বিভাগের প্রধান অসীম চক্রবর্তী জানিয়েছেন, রিংগার ল্যাকটেট নামে যে দ্রবণ দিয়ে রোগীর চোখ ধোয়া হয়,
তা থেকেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে তাঁদের অনুমান। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পরপর বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি-মৃত্যু নিয়ে আলোড়িত হয়েছিল গোটা স্বাস্থ্য দফতর। দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই ফের চোখের সাধারণ অস্ত্রোপচার থেকে এমন সংক্রমণের ঘটনায় বিব্রত স্বাস্থ্য কর্তারা। চক্ষু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপস্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য এখনও তাঁর কাছে পৌঁছয়নি। আরজিকর থেকে যাবতীয় তথ্য তলব করছেন তিনি।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ঘটনাটিকে হয়তো অনেকেই ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করবেন। সারা বছর হাসপাতালে যত অস্ত্রোপচার হয়, তার তুলনায় এই সংক্রমণের হার হয়তো খুবই নগণ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে মানুষেরা দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন, তাঁদের কাছে এটা নগণ্য নয়। সেই গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। আরআইও-র বিশেষজ্ঞেরা জানান, রিংগার ল্যাকটেট নামে দ্রবণ যে কাচের বোতলে রাখা হয়, তা জীবাণুমুক্ত করার জন্য অটোক্লেভ করতে পারলে সংক্রমণ হয়তো এড়ানো যেত। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সেটা হয়নি। এ ছাড়া ওষুধের ব্যাচ নম্বর ধরে পরীক্ষা এবং প্রস্তুতকারক সংস্থার কোনও গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও করেছেন অনেক চিকিৎসক।
সংক্রমণের অন্য একটি সম্ভাব্য কারণের দিকেও আঙুল উঠেছে। আরজিকরের চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ জানিয়েছেন, একই দিনে যত জন রোগীর অস্ত্রোপচার করার মতো সরঞ্জাম হাসপাতালে মজুত রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রোগীর অস্ত্রোপচার হচ্ছে। ফলে সরঞ্জাম যথাযথ ভাবে জীবাণুমুক্ত হওয়ার আগেই তা ফের ব্যবহৃত হচ্ছে। চক্ষু চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রিংগার ল্যাকটেটের বোতল অটোক্লেভ করা দরকার। পাশাপাশি, একটি বোতল যে দিন খোলা হচ্ছে, দ্রবণ সে দিনই শেষ করা উচিত। ওই দ্রবণ ব্যবহারের সময়ে আরও যে সব সরঞ্জাম কাজে লাগানো হয়েছে, সেগুলিও জীবাণুমুক্ত ছিল কি না, তা জানা দরকার।’’ প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা সরঞ্জাম ব্যবহারের উপরেও জোর দিয়েছেন তিনি।
আরজিকরে চক্ষু বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমরা অস্ত্রোপচারটা করি। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা বিধি মানা হচ্ছে কি না, তার খুঁটিনাটি আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। সেই দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট না হলে অহেতুক ডাক্তারদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’’