কোনও কোনও প্রবীণ ক্যালকাটানের কাছে এ যেন শীতের প্রেমপত্র। এক সময়ে তাকে ডাকাও হতো লাভ লেটার বলে।
বৌবাজারের এক ঘিঞ্জি গলি থেকে দিকে দিকে যা ছড়িয়ে পড়ত। শহরের নামজাদা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা বো ব্যারাকের ঠিক পিছনের চিলতে দোকানঘরে তার জন্ম। কর্তা মন্টু বড়ুয়া ছবির ফ্রেমে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরনো প্রেমপত্রও কলকাতার জীবন থেকে মুছে গিয়েছে।
চিঠি বলতে এক ধরনের কেক। ছানার কেক। খানিকটা ঘিয়ে রঙা মোটা সুদৃশ্য কাগজে মুড়ে ফি-বছর শীতে সে আসত এ শহরের জীবনে। কাগজটার নামই লাভ লেটার। এখন অ্যালুমিনিয়মের ফয়েলই ভরসা। বছর দেড়েক আগে প্রয়াত বড়ুয়াদের ওই বেকারির কর্তা ‘মন্টুদা’র স্ত্রী কৃষ্ণা বউদি বলছিলেন, ‘‘সেই পুরনো কাগজটা ভাঁজ করে আভেনে খামির ভরে দিলে কেক দিব্যি বেক হতো। কাগজেরও ক্ষতি হতো না! লাভ লেটার বিক্রি হতো কাগজে মুড়েই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এখন আর ওই কাগজ সহজে মেলে না, কারখানায় কাগজ ভাঁজ করার জন্যও বাড়তি কয়েক জন মিস্ত্রি লাগে। বড় ঝক্কি। তার থেকে ফয়েলই ভাল।’’
মোড়ক পাল্টালেও ছানার কেকের আবেদন ফিকে হয়নি। বছর দশেক আগে প্রোমোটারির জেরে বড়ুয়াদের কারখানা উৎখাত হয়েছে। রবার্ট স্ট্রিটে দোকান থাকলেও ডোমজেল লেনে ভাগাভাগির চিলতে খোপে কারখানা। তবে বড়ুয়ারা ছানার কেক জিইয়ে রাখলেও আশপাশে ফিয়ার্স লেন লাগোয়া এলাকায় কিছু বেকারি ঝাঁপ বন্ধ করেছে। ছানার কেক, অন্য কেকের মতো টেঁকসই নয়। দিন তিন-চার তার আয়ু। ডিসেম্বরের শেষ থেকে শুরু করে বড়জোর জানুয়ারির শেষটা তার দেখা মেলে। রসিকজনে এখনও এর খোঁজে দূর থেকে বৌবাজারে আসেন।
একেলে কলকাতায় অনেকের কাছে অজানা, এই ধ্রুপদী কলকাত্তাইয়া মিষ্টি বা কেকের আঁতু়ড়ঘর অবশ্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আন্টিদের হেঁসেলে। বো ব্যারাক পাড়ায় শীতের দুপুরে আচমকা হানা দিলে অনেকের ভাগ্যেই কোনও স্নেহশীল গৃহিনীর আপ্যায়নে এই ছানার কেকের টুকরো জুটেছে। সন্দেশখোর বাঙালি জিভ তাতে চমৎকৃত হয়। তামাম হিন্দুস্থানের থেকে ভিন্ রাস্তায় হেঁটে একদা দেবতার অখাদ্য ছিন্ন করা দুধ তথা ছানাকেই ঠাকুরের প্রসাদ করে তোলে বাঙালি। ছানার কেকে খানিক ওড়িশার ‘ছেনা পোড়া’র ছোঁয়াচ। ডিম, খোয়া ক্ষীর, রকমারি মোরব্বা, কিসমিসের মিশেল। আর বুকেতে ক্যারামেলাইজড চিনির অভিঘাতে রমণীয় তিক্ততা। এখনও বো ব্যারাকে অ্যাঞ্জেলা গোবিন্দরাজ প্রমুখ জনা কয়েক গিন্নির কাছে অর্ডার দিলে ছানার কেক কেনা যায়। আগে ময়দার বিস্কুটের খোলে ছানার পুর ভরে টার্টের আদলে চিজ কেকও বিক্রি করতেন বড়ুয়ারা। এখন টিকে আছে শুধু ছানার কেক। তা বিক্রি হয় ছোট ছোট টুকরোয়। কৃষ্ণা বড়ুয়া বলছিলেন, ‘‘বৌবাজারে আমাদের বাঁধা ছানা সাপ্লায়ার আছে। রসগোল্লার ছানা ছাড়া এ জিনিস হবে না!’’
উত্তর-দক্ষিণের কিছু সাবেক কেবিনে ছানার পুডিংয়ের মতোই এ শহরে ছানার কেককে খুঁজতেও অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখতে হয়। শিয়ালদহের কিছু বেকারি, কয়েকটি মিষ্টির দোকানেও দৈবাৎ দেখা মেলে। বৌবাজারের বেকারিতে ফি-শীতে ছানার কেকের টানে আসেন টালিগঞ্জের রবীন ভৌমিক। বলছিলেন, ‘‘মিষ্টির দোকানের ছানার কেক আর যা-ই হোক, কেক নয়!’’
ভবানীপুরের বলরাম ময়রার উত্তরপুরুষ সুদীপ মল্লিকের মতে, ‘‘ডিম থাকে বলে ছানার কেক মিষ্টির দোকানে চলে না। আবার ছানা কাটানোর কসরত সব বেকারির মিস্ত্রি রপ্ত করতে পারেন না।’’ ওড়িশার ছানাপোড়া ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের ছানা কেকের আদলে কিছু নতুন এগলেস সৃষ্টি পানাকোটা, অ্যামব্রোসিয়ায় হাত পাকিয়েছেন সুদীপ।
মন্টুবাবু গত হওয়ার পরে খানিক বেসামাল তাঁর ভাই রতন, পুত্র রিন্টু। বললেন, ‘‘বাবার মতো অত ভাল ব্যবসা বুঝি না! তবু ভক্তদের আবদারে ছানার কেক নিয়ে লড়ে যাচ্ছি!’’
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী