সেই যৌনপল্লির কাছে শিবির, ফোনেই উধাও ডাক্তাররা

সমালোচনা হচ্ছে, চলছে বিতর্কও, কিন্তু যৌনপল্লির দু’কিলোমিটারের মধ্যে আয়োজিত রক্তদান শিবির থেকে সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কের রক্ত নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। শনিবার দুপুরে বৌবাজারের হাড়কাটা গলি লাগোয়া ১৪ নম্বর জগবন্ধু লেন-এ ‘মধ্য কলকাতা ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০২:৫৪
Share:

চলছে রক্তদান শিবির। বৌবাজারের হাড়কাটা গলি লাগোয়া এলাকায়। শনিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

সমালোচনা হচ্ছে, চলছে বিতর্কও, কিন্তু যৌনপল্লির দু’কিলোমিটারের মধ্যে আয়োজিত রক্তদান শিবির থেকে সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কের রক্ত নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না।

Advertisement

শনিবার দুপুরে বৌবাজারের হাড়কাটা গলি লাগোয়া ১৪ নম্বর জগবন্ধু লেন-এ ‘মধ্য কলকাতা ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় স্মৃতিরক্ষা কমিটি’ একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। রক্ত নিতে আসে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ (এনআরএস) হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্ক। শিবির চালাকালীনই খবর পৌঁছে যায় স্বাস্থ্যভবনে। ফোনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ভর্ৎসিত হয়ে মাঝপথে রক্ত নেওয়া থামিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যান এনআরএসের চিকিৎসকেরা। যাঁরা রক্ত দেবেন বলে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁরা তো হতভম্ব! চরম অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়া আয়োজকেরা তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘‘খুব বৃষ্টি পড়ছে, আবহাওয়া খারাপ। তাই এনআরএস কর্তৃপক্ষ ডাক্তারদের ফিরে যেতে বলেছেন।’’

যে মেডিক্যাল অফিসার এনআরএসের ব্লাডব্যাঙ্কের তরফে শিবিরে এসেছিলেন সেই শিবময় দাস বলেন, ‘‘আমাদের ব্লাডব্যাঙ্কের ইনচার্জ দিলীপ পণ্ডার নির্দেশেই গিয়েছিলাম। আবার উনিই দ্রুত ফিরে আসতে বলেন বলে চলে এসেছি।’’ দিলীপ পণ্ডার কথায়, ‘‘ওই শিবিরে যৌনপল্লির কোনও লোক যাবেন না বলেই আমাদের মনে হয়েছিল। তাই রাজি হয়েছিলাম।’’

Advertisement

এনআরএসের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, তিনি বা সুপার শেখ আলি ইমাম কেউই এই রক্তদান শিবির সম্পর্কে জানতেন না। দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘জানার পরেই আমি এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। শো-কজ করেছি ব্লাডব্যাঙ্কের ইনচার্জকেও। ওই শিবিরে প্রায় ৭৫ জনের রক্ত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৪০ জন রক্ত দেওয়ার পরেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় ডাক্তারবাবুরা রক্ত নেওয়া থামিয়ে দেন। সংগৃহীত ৪০ ইউনিট রক্ত ব্যবহার না করে ফেলে দিতে হবে।’’

কিছু দিন আগেই পরপর সোনাগাছি এবং হাড়কাটা গলি যৌনপল্লির দু’কিলোমিটারের মধ্যে আয়োজিত রক্তদান শিবির থেকে রক্ত নিয়েছিল মানিকতলা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাডব্যাঙ্ক। সেই খবর প্রকাশিত হওয়ায় যথেষ্ট শোরগোল পড়ে যায়। ফলে দু’দিন আগেই ওই দুই ব্লাডব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ লিখিত ভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ওই শিবিরগুলি থেকে সংগৃহীত মোট ২২২ ইউনিট রক্ত ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তার পরেও কী করে এনআরএসের ব্লাডব্যাঙ্ক একই ধরনের একটি শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

‘জাতীয় এডস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা’ (ন্যাকো)-র নিয়মানুযায়ী, যৌনপল্লির দু’কিলোমিটারের মধ্যে রক্তদান শিবির করা যায় না। কারণ যৌনকর্মী, তাঁদের বাবু, যৌনকর্মীদের সন্তান, ওই পল্লির অন্য অনেক বাসিন্দার দেহে এইচআইভি-সহ নানারকম যৌন রোগ থাকার আশঙ্কা, যা রক্তের মাধ্যমে অন্যের শরীরে সংক্রামিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও সোনাগাছি ও হাড়কাটা গলির কাছে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছে অনেক স্থানীয় ক্লাব। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এই সব উদ্যোগের পিছনে শাসক দলেরই নেতা-সমর্থকদের ভূমিকা রয়েছে। তাদের চাপে পড়েই সরকারি হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কগুলি ওই শিবিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।

সোনাগাছি অঞ্চলের শিবিরে হাজির ছিলেন মন্ত্রী শশী পাঁজা, হাড়কাটা গলির শিবিরে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন হাড়কাটা গলির দু’কিলোমিটারের মধ্যে জগবন্ধু লেনে আয়োজিত শিবিরে যাওয়ার কথা ছিল সুদীপ ও নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অন্তত কার্ডে তাঁদের নাম ছাপানো হয়েছে। তবে তাঁরা যাননি। গিয়েছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় ও স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলার সত্যেন্দ্রনাথ দে।

কেন ওই শিবিরে তাঁরা গিয়েছিলেন? বিধায়ক তাপস রায়ের যুক্তি, ‘‘ওই ক্লাবটি বেশ নামকরা, পুরনো ক্লাব। কৌলিন্য আছে। অনেক দিন থেকেই শিবির করে। যদি রক্তদাতাদের কারও শরীরে কোনও রোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে সংগৃহিত রক্ত কাউকে দেওয়ার আগে রুটিন পরীক্ষা করলেই ধরা পড়বে। অসুবিধার কী আছে?’’ কিন্তু চিকিৎসকদের মতে, এইচআইভি রক্তে বাসা বাঁধার বেশ কিছু দিন পরে পরীক্ষায় ধরা পড়ে। তাই রক্তের মাধ্যমে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যায়।

স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলার সত্যেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘এত দিন তো এইসব নিষেধাজ্ঞা ছিল না। হঠাৎ কী সব শুরু হয়েছে! গত কুড়ি বছর ধরে আমাদের পাড়ায় রক্তদান হয়েছে। এটা তো আর যৌনপল্লি নয়, তা হলে বাধা হবে কেন? এই রকম চললে তো আমরা জনপ্রতিনিধিরা কোনও ব্লাডকার্ড পাব না। প্রয়োজনে গরিব রোগীকে কার্ড দিতেও পারব না।’’

একই মত আয়োজক ক্লাবের কার্যকরী সভাপতি হরিনারায়ণ চন্দের। বলেন, ‘‘অনেক বছর ধরে আমরা শিবির করছি। কেউ আপত্তি করেনি। কোনও খারাপ লোক আমাদের শিবিরে আসেন না। অযথা আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।’’

শুধু শিবিরের জায়গার ব্যাপারেই যে নিয়ম ভাঙা হয়েছে তা নয়, শিবিরে রক্তদাতার প্রত্যেককে ৩০ লিটারের স্টেনলেস স্টিলের বালতিও ‘উপহার’ দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ প্রসঙ্গে হরিনারায়ণবাবুর উত্তর, ‘‘শিবিরে উপহার দেওয়া বেআইনি জানি। তবে আমরা তো উপহার দিয়ে রক্তদানে প্রলোভিত করছি না। বরং ভাল কাজের একটা প্রতীকী স্বীকৃতি দিচ্ছি। এইটুকু তো করতেই হয়।’’

বিতর্কের মুখে এনআরএস কর্তৃপক্ষ সংগৃহীত রক্ত ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুনে ক্ষুব্ধ হরিনারায়ণবাবু বলেন, ‘‘এর মানে কী? রক্তে কোনও গোলমাল পেলে ফেলতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা না করে এমনি এমনি ফেলে দেবে! যা ইচ্ছা তাই করবে নাকি! তা হলে আমরা আর রক্তদান শিবির করব কেন? সব বন্ধ করে দেব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement