রোগ দমনে দুই রাজ্যের শরণে বাংলা

সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৮ জন। এত দিনে নড়েচড়ে বসল সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবন! উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের মোকাবিলায় জোড়া ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। এবং দু’টি ব্যবস্থাই নিতে হচ্ছে ভিন্ রাজ্যের সহযোগিতায়। মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু। উত্তরবঙ্গে দ্রুত সংক্রমিত রোগের স্বরূপ জানতে পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির শরণাপন্ন হয়েছে বাংলা। মঙ্গলবারেই পুণে থেকে দুই সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম এসেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৪ ০২:৪০
Share:

সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৮ জন। এত দিনে নড়েচড়ে বসল সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবন!

Advertisement

উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের মোকাবিলায় জোড়া ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। এবং দু’টি ব্যবস্থাই নিতে হচ্ছে ভিন্ রাজ্যের সহযোগিতায়। মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু।

• উত্তরবঙ্গে দ্রুত সংক্রমিত রোগের স্বরূপ জানতে পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির শরণাপন্ন হয়েছে বাংলা। মঙ্গলবারেই পুণে থেকে দুই সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম এসেছে।

Advertisement

• রোগ প্রতিরোধের যথাযথ বন্দোবস্ত করতে মাদুরাইয়ের পতঙ্গবিদদের সাহায্য চেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এ দিন বলেন, “মাদুরাইয়ের সেন্টার ফর রিসার্চ অব মেডিক্যাল এন্টেমোলজির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের প্রতিনিধিরা চলে আসবেন।” তবে জনস্বাস্থ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের বক্তব্য, এ ভাবে ভাড়া করে পতঙ্গবিদ এনে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যাবে না। রাজ্যের নিজস্ব পতঙ্গবিদ-বাহিনী প্রয়োজন।

কিন্তু রোগ প্রতিরোধের লড়াইয়ে ভিন্ রাজ্যের সাহায্য নিতেই বা এত দেরি হল কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে। জুনের শেষ থেকেই উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ ছড়াচ্ছে অতি মাত্রায়। জলপাইগুড়ি থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্য চারটি জেলায়। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসকদল উত্তরবঙ্গ ঘুরে এসে রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের পরেও বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। কেন?

সরাসরি জবাব দেওয়ার কেউ নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জনবাবু আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেছেন। বুঝেছেন, রোগ নির্ণয়ের পরিকাঠামো যেমন দুর্বল, তেমনই দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সেই জন্যই জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ছাড়াও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-সহ আর কোন রোগ হানা দিয়েছে, তা জানতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। ব্যাপক সংক্রমণের পিছনে অন্য জীবাণু আছে কি না, তা জানা যায়নি এখনও।

ইতিমধ্যে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে এ বছর ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁদের মধ্যে ২২ জন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মারা গিয়েছেন। বাকিদের সংক্রমণের কারণ এখনও অজানা। সোমবার বিকেলের পর থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত এনসেফ্যালাটিসের উপসর্গ নিয়ে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের এক জন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত বলে জানান উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

এনসেফ্যালাইটিসের মোকাবিলায় রাজ্য সরকার যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে আনা যেত, এখন তা বুঝতে পারছেন স্বাস্থ্য ভবন থেকে উত্তরবঙ্গ সফরে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্তারা। এই অবস্থায় টিকাকরণ কর্মসূচিতে কোনও গলদ ছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। ডুয়ার্স এলাকা এমনিতেই ম্যালেরিয়া-প্রবণ। তা সত্ত্বেও ওই এলাকার স্বাস্থ্য দফতরে কোনও পতঙ্গবিদ নেই কেন, উঠছে সেই প্রশ্নও। পতঙ্গবিদ থাকলে নিয়মিত সমীক্ষায় আগেই ধরা পড়ে যেত, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কী ভাবে কিউলেক্স বিষনোই মশা বেড়েছে। ওই মশাই আক্রান্ত শুয়োর কিংবা পাখি থেকে জীবাণু-ভরা রক্ত নিয়ে মানুষের মধ্যে তার সংক্রমণ ঘটায়। ভিন্ রাজ্যের পতঙ্গবিদ এনে আপাতত কাজ চালানোর চেষ্টা হলেও জনস্বাস্থ্য-কর্মীদের বক্তব্য, এই ধরনের পরিস্থিতি রুখতে রাজ্যের নিজস্ব পতঙ্গবিদ-বাহিনী না-গড়লেই নয়। নিজেদের পতঙ্গবিদ থাকলে তাঁরা বছরভর সমীক্ষা চালিয়ে এমন পরিস্থিতির সূচনাতেই সতর্ক করতে এবং ব্যবস্থাপত্র দিতে পারবেন।

উত্তরবঙ্গে যে-সব রোগীর জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়েনি, তাঁদের সমস্যাটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস নির্ণয়ের ব্যবস্থা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে আছে। কিন্তু অন্য ধরনের ভাইরাসে এনসেফ্যালাইটিস হলে তা জানার পরীক্ষা-ব্যবস্থা নেই। ট্রপিক্যালের ভাইরোলজির প্রধান-সহ একটি মেডিক্যাল টিম বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে রক্তের নমুনা নিয়ে গিয়েছে।

কী ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটছে, সেই ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য তাঁরাও রক্ত-সহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করবেন বলে এ দিন জানান পুণে থেকে আসা দলের অন্যতম সদস্য তথা গবেষক বি টি ট্যান্ডেল। তাঁর দল রোগীদের রক্তের নমুনা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মলমূত্রের নমুনাও পরীক্ষা করবে। সে-ক্ষেত্রে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ছাড়া এন্টেরো-ভাইরাসের আক্রমণে কেউ এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন কি না, তা জানা যেতে পারে। আর একটি সমস্যা নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা পুণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেটি হল, এ বার বয়স্কদের মধ্যেও ওই রোগ হানা দিল কেন?

এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, গত বছর থেকে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছিল ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সিদের। কিন্তু এ বছর ওই রোগে বয়স্কেরাই মারা যাচ্ছেন বেশি। এর জন্য জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের নতুন কোনও প্রজাতির ভাইরাস দায়ী কি না, বোঝা যাচ্ছে না। এ দিন জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতাল এবং মালবাজার মহকুমা হাসপাতালে যান রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা। নাগরাকাটা ব্লকের শুল্কাপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যান তিনি। ওই এলাকায় এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে সম্প্রতি দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্তদের খোঁজখবর নেন তিনি। সূর্যবাবু পরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে এসেছিলেন। তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এলে ভাল হতো। নজরদারি আরও জোরদার হতে পারত।” তাঁর অভিযোগ, দু’বছর ধরে এই রোগের সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিয়েছে। গত বছরও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে মারা গিয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। আগে থেকে কিট সরবরাহ করলে এবং রোগ প্রতিরোধে অন্যান্য ব্যবস্থা নিলে প্রাণহানি কমানো যেত বলে মন্তব্য করেন বাম জমানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও চিকিৎসক সূর্যবাবু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement