লোভনীয়: নিজ়ামের টেবিলে ফিরল বিফ দিয়ে তৈরি নানা খাবার। শুক্রবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কয়েক বছর আগে হঠাৎই উবে গিয়েছিল সে। ঠিক কী কারণে, খাতায়-কলমে তা কেউই স্পষ্ট করেনি। কিন্তু কলকাতার কয়েক দশকের স্বাদ-রোম্যান্স বা কারও কারও নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ সঙ্গে নিয়ে নিউ মার্কেট পাড়া থেকে বেমালুম মুছে গিয়েছিল নিজ়ামের বিফ রোল।
শুক্রবার সে ফিরে এসেছে। ১৯৩২ সালের পুরনো হোটেলের মালিকানার হাতবদল হয় কয়েক বার। তবে বিফ রোলের মিথ আরও পুরনো। লখনউ থেকে মেটিয়াবুরুজে নির্বাসিত রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের দলের রেজা খানের চুবড়িতে শালপাতা মোড়া কাবাব-রুটি বিক্রি এবং ফিরিঙ্গি সাহেবদের হাত তৈলাক্ত হওয়া ঠেকাতে ক্রমে কাগজের মোড়কের উদ্ভব নিয়ে নানা লোককথা রয়েছে। কলকাতা পুরসভার অফিস-বাড়ি তৈরি হওয়ার পরে তার নীচেই নিজ়ামের অধিষ্ঠান ক্রমে জনপ্রিয়তার কৌলিন্যে জমজমাট। কিন্তু সাবেক মালিকদের থেকে হস্তান্তরের চক্করে সেরা আকর্ষণ বিফ রোলকেই নির্বাসনে পাঠানো হয়। “কাজটা ঠিক হয়নি,” বলছেন নিজ়ামের বর্তমান কর্ণধার সমর নাগ। সমরবাবুর কথায়, “পুরনো নিজ়াম-ভক্তেরা অনেকে অভিমান বা রাগও করেছিলেন। এমনও শুনতে হয়েছে, নিজ়াম থেকে বিফ রোল সরানো মানে তো নকুড়ের দোকানে সন্দেশ বিক্রি বন্ধ বা চিনেপাড়ায় নুডলস, ওয়ান্টন বিক্রি বন্ধ করার মতো অস্বাভাবিক গর্হিত কাজ। সুযোগ পেয়েই ভুলটা শুধরে নিয়েছি।” সমরবাবুর আগে কিছু দিন প্রাক্তন ক্রিকেটার চেতন শর্মা নিজ়াম চালিয়েছেন। তখনই মেনু পাল্টানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত এক দশকে সমরবাবুর জমানায় নিজ়ামের একটি লাগোয়া অংশ মোগল গার্ডেনে বিফ মিলত। পরে নানা কার্যকারণে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এখন পুরোটাই ফের নিজ়াম বলে চিহ্নিত।
নিজ়াম থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বিফ, পর্কের রকমারি ঠান্ডা মাংসের সম্ভারে বিখ্যাত কালম্যানের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে কয়েক বছর আগে। এ দেশের নানা প্রান্তেই বছরের কিছু বিশেষ সময়ে আমিষ-বিমুখতা নিয়ে নানা রাজনৈতিক চাপের অভিযোগও উঠেছে। কলকাতাতেও আমিষ মেনু নিয়ে কয়েকটি এলাকায় অল্পস্বল্প আড়ষ্টতা দেখা যায়। তবে এ শহরের খাদ্য ঐতিহ্যপ্রেমীদের বিচারে বরাবরই ‘আপ রুচি খানা’ এবং অপরের খাদ্যাভ্যাসকে সম্মান করার সংস্কৃতিই প্রাধান্য পেয়েছে। এখন নিজ়ামে পাশাপাশি দু’টি বিভাগে বিফ এবং বিফবিহীন মেনুর টেবিল বসছে। দোকানের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ কাবাব-শিল্পী সৈফুদ্দিন খান ফিরে এসেছেন। কাবাবের কাঠকয়লার আঁচের স্বাদও অটুট রাখা হচ্ছে। আজকের কলকাতায় ইনট্যাকের উদ্যোগে ১৯৬০-এর আগের বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী রেস্তরাঁকেই তাদের মেনু এবং ব্যবসার ধারাবাহিকতার জন্য আবহমান সাংস্কৃতিক পরম্পরার (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ) স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
হেরিটেজ স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশের মতে, “খাবারের মেনুও অবশ্যই ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিজ়ামে বিফ রোলের ফিরে আসাকে সে দিক দিয়ে স্বাগত জানানোরই।” টানা লকডাউন পর্বের পরে নিজ়াম ঢেলে সাজানো হয়েছে। অন্য মোগলাই দোকানের কয়েক জন বাবুর্চিও যোগ দিয়েছেন। রেস্তরাঁর সাজসজ্জায় এখন মিশেছে বাংলার সিনেমা ও সাহিত্য জগতের নানা ছবিও। নিজ়াম-কর্তারা এর পরে রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের একটা ছবিও বসাতে চান। মেনুতে রোলের সঙ্গে বিরিয়ানি, চাঁপ থেকে নানা কিসিমের মোগলাই পদ। সব মিলিয়ে বাঙালি বা কলকাতার দেওয়া-নেওয়া, মেলামেশার সাংস্কৃতিক মোহনার স্মারক মেলে ধরাই লক্ষ্য শহরের সাবেক রোলতীর্থে।