প্রতীকী ছবি।
দশটি জিনিসের নাম আওড়াতে আওড়াতে থলি হাতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ঢুকলেন পাঁচটি জিনিস নিয়ে। বাকি পাঁচটি বেমালুম ভুলে গিয়েছেন! বছর তিনেক দেখা নেই বাল্যবন্ধুর সঙ্গে। তাই বলে আচমকা আসা সেই বন্ধুকে দরজা খুলে চিনতেই পারলেন না গৃহকর্তা বন্ধু! ঘুরে বেড়াতে ভালবাসা বৃদ্ধ মানুষটির এখন আর রোজ বেরোনো হয় না। যখন বেরোন, অবাক দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকেন বছর সত্তরের বৃদ্ধ। চেনা রাস্তা আজকাল বড্ড অচেনা ঠেকে!
‘বইপোকা’ বলে পরিচিত মানুষটি কিছুই পড়তে চান না। বাড়ির লোকেরা ভাবলেন, ছানির জন্য হয়তো পড়তে সমস্যা হচ্ছে। অস্ত্রোপচার করিয়ে দিব্যি ভাল হয়ে গেল চোখ। তবু কিছুই পড়ার আগ্রহ নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে একই কথা বার বার বোঝাতে হয় তাঁকে। একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত সঙ্গের মানুষটি।
অবসরের পর থেকেই মেজাজটা তিরিক্ষি হচ্ছে। সে দিন তো চূড়ান্ত লজ্জায় পড়েছিলেন পরিজনেরা। ডায়াবিটিসের রোগী বলে মিষ্টি বাড়িতে ঢোকেই না। কিন্তু অতিথিকে মিষ্টি সাজিয়ে দিয়েছিলেন বৌমা। আচমকা প্লেট থেকে মিষ্টি তুলে খেয়ে নিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বৃদ্ধ!
আরও পড়ুন: ওপেন বা এনলার্জড পোরস নিয়ন্ত্রণ করবেন কী ভাবে?
উপরের এই ছক ভাঙা পরিবর্তন আচরণে আসে কেন? ভাবেন কি পরিজনেরা? চিকিৎসকেরা বলছেন, চাপা পড়ে থাকা এই সব সমস্যা নিয়ে রোগীরা যখন আসেন, তত ক্ষণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে অনেকটা। তাঁদের মতে, এমন সমস্যা ইঙ্গিত দেয় ডিমেনশিয়ার। তবে ডিমেনশিয়া রোগ নয়। বিভিন্ন রোগের উপসর্গ এটি। সমীক্ষা বলছে, ডিমেনশিয়ার উপসর্গযুক্ত প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষই অ্যালজ়াইমার্স রোগের শিকার। অথচ, এই রোগ নিয়ে সে ভাবে সচেতনতাই নেই চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে, মানছেন ডাক্তারেরা।
আরও পড়ুন: প্রস্টেট গ্রন্থির চিকিৎসা মানেই অপারেশন নয়
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান, চিকিৎসক সন্দীপ পাল জানাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অ্যালজ়াইমার্স জিনঘটিত রোগ নয়। মূলত ৬৫ বছরের আশপাশে এই রোগ হতে পারে। মস্তিষ্কের কোষে অ্যামাইলয়েড প্রোটিনের অতিরিক্ত উৎপাদন এবং কম নিষ্কাশনে সেখানে তা জমে থাকে। অ্যালজ়াইমার্স রোগের কারণ এই অস্বাভাবিকতা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই প্রোটিন সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে (সিএসএফ) গিয়ে পড়ে। লাম্বার পাঙ্কচার এবং সিএসএফ পরীক্ষা করে ওই প্রোটিনের উপস্থিতির পরিমাণ দেখে রোগ নির্ণয় হয়। তবে এই পদ্ধতি এ দেশে প্রচলিত নয়। এখানে চিকিৎসকেরা ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণ অথবা ইমেজিং পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় করেন।
আরও পড়ুন: কোভিড রুখতে সহকর্মীর পেনেও হাত নয়!
এই রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছলে চিকিৎসায় ফল মেলে না। ফলে এখন চিকিৎসকদের লক্ষ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে ডিমেনশিয়ার উপসর্গ চিহ্নিত করা। একে বলা হয় এমসিআই (মাইল্ড কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট)। সন্দীপবাবুর কথায়, “দেখা গিয়েছে, এমসিআই রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ অ্যালজ়াইমার্স রোগী হিসেবে সামনে আসেন। এই অসুখটি ‘প্রোগ্রেসিভ ডিজ়িজ’, ফলে প্রথমে চিকিৎসা শুরু হলে রোগের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখা যায়।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে ডিমেনশিয়ার সাপ্তাহিক ক্লিনিক চলে। সেখানেই জোর দেওয়া হয় এমসিআই রোগীদের চিহ্নিতকরণে। নিউরোলজি বিভাগ-চালিত ওই ক্লিনিকে সাইকায়াট্রিস্টরাও থাকেন।এন্ডোক্রিনোলজিস্ট কৌশিক সাহার মতে, “অ্যালজ়াইমার্স রোগকে ঠেকিয়ে রাখতে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যিক। জীবনযাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।”
আরও পড়ুন: প্রোটিন শেক কখন খাবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এই রোগ ঠেকাতে শারীরচর্চা, ধূমপান বন্ধ করা এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট নিখিলপ্রসূন সিংহ বলছেন, “ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করতে হবে রোগীকে। বেশি করে শাকপাতা, আনাজ এবং ফল খেতে হবে।” চিকিৎসকেরা জোর দিচ্ছেন মনের ব্যায়ামেও। বই পড়া, গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা যে কোনও শিল্পচর্চা করা, বাগান করা, দাবা খেলার মতো বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। এই রোগের চূড়ান্ত পর্যায়টা রোগীর পক্ষে কষ্টকর। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই রোগকে ঠেকিয়ে রাখতে সতর্ক হতে হবে।