প্রতীকী ছবি।
বছর পঁয়ত্রিশের যুবককে গ্রাস করছিল অবসাদ। শুরু হয় তাঁর মনোরোগের চিকিৎসাও। বছর পাঁচেক পরে এক দিন কর্মক্ষেত্রে শুরু হল প্রবল কাঁপুনি। স্নায়ুরোগ চিকিৎসককে দেখাতেই জানালেন, কাঁপুনির কারণ পার্কিনসন্স। যাকে বলে ‘ইয়ং অনসেট পার্কিনসন্স ডিজ়িজ়’ (ওয়াইওপিডি)। চিকিৎসকদের মতে, অবসাদই ছিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
চিকিৎসা শুরু হয় তাঁর। কিন্তু পার্কিনসন্সের ওষুধ লেভোডোপা দীর্ঘদিন খেয়ে আর কাজে দিচ্ছিল না কুণাল সেন মজুমদার নামে ওই যুবকের। বিছানায় কুঁকড়ে গিয়ে জিভ বার করে কাঁপতেন তিনি। পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় ‘ডিপ ব্রেন স্টিমিউলেশন’ (ডিবিএস) চিকিৎসার। সালটা ২০১৪। কলকাতায় সবে শুরু হয়েছে মস্তিষ্কে পেসমেকার বসিয়ে পার্কিনসন্স রোগের এই অস্ত্রোপচার। পার্ক সার্কাসে স্নায়ুরোগ চিকিৎসার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন কুণাল।
আগামী ১১ এপ্রিল বিশ্ব পার্কিনসন্স সচেতনতা দিবস। ভাই কুণালের কারণেই এই রোগের সচেতনতার প্রচারে জড়িয়ে গিয়েছেন দিদি মিত্রা সেন মজুমদার। ২০১৫ সালে স্নায়ুরোগ চিকিৎসক হৃষীকেশ কুমারকে নিয়ে তৈরি করেন ‘পার্কিনসন্স ডিজ়িজ় পেশেন্টস ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কলকাতা’। তবে সচেতনতার প্রসারে লড়াই অনেক বাকি, মানছেন মিত্রা। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সারা দেশে পার্কিনসন্স রোগীর সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। ১৯৯০ সালে পার্কিনসন্স রোগীর যে সংখ্যা ছিল, ২০১৫-য় তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। পরবর্তী ২৫ বছরে তা এরও দ্বিগুণ হতে চলেছে, জানাচ্ছেন স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অমিতাভ ঘোষ। চিকিৎসকদের মতে, প্রকোপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান গড় আয়ু। রয়েছে আরও কিছু কারণ। যেমন, চাষে কীটনাশকের ব্যবহার, প্লাস্টিক-দূষণ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ এবং কম সংখ্যক হলেও জেনেটিক মিউটেশন। ষাটের পরে পার্কিনসন্সের আশঙ্কা বাড়লেও কমবয়সিদের মধ্যেও এই রোগ দেখা যাচ্ছে, যার কারণ জেনেটিক মিউটেশন।
‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস’-এর শিক্ষক-চিকিৎসক অতনু বিশ্বাস জানাচ্ছেন, গবেষণামূলক সমীক্ষায় বর্ধমানের গলসিতে ওয়াইওপিডি-র অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। প্রাথমিক অনুমান, কৃষিপ্রধান ওই এলাকায় কীটনাশকের ব্যবহারই এর মূল কারণ। অতনুবাবুর কথায়, ‘‘প্রাথমিক লক্ষণ দেখলেই দ্রুত স্নায়ুরোগ চিকিৎসককে দেখাতে হবে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’’ রোগের নিয়ন্ত্রণে
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় নিয়মানুবর্তিতার বড় ভূমিকার কথা মানছেন অমিতাভবাবু। তিনি বলেন, ‘‘খাদ্য-তালিকায় আনাজ, ফল এবং মাছ-সমৃদ্ধ মেডিটেরেনিয়ান ও ‘মাইন্ড ডায়েট’ এ ক্ষেত্রে কার্যকর। যোগব্যায়াম ও হাঁটা রোগের গতি রোধ করে। এ সব পার্কিনসন্সে আক্রান্ত হওয়াও ঠেকাতে পারে।’’
মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোনের কম নিঃসরণই পার্কিনসন্স রোগের কারণ। চিকিৎসকদের কথায়, ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় হয়। এর চিকিৎসা লেভোডোপা-নির্ভর। রোগ জটিল হলে আছে ‘ডিপ ব্রেন স্টিমিউলেশন’ (ডিবিএস)। অমিতাভবাবু জানাচ্ছেন, এই চিকিৎসা শহরের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে হয়। তবে তা ব্যয়বহুল। এই অস্ত্রোপচার সফল হলে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। ওষুধ তখন কম খেতে হয়।
সরকারি পরিকাঠামোয় প্রথম এই অস্ত্রোপচার শুরু করতে চলেছে বিআইএন। অতনুবাবু জানাচ্ছেন, কিছু যন্ত্র এসে গিয়েছে। চলতি বছরেই শুরু হতে পারে মস্তিষ্কে পেসমেকার বসানোর অস্ত্রোপচার। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, শহরের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই স্নায়ুরোগের বহির্বিভাগে পার্কিনসন্সের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসতে পারেন। শহরে পার্কিনসন্সের সব থেকে পুরনো সরকারি ক্লিনিক চলে বিআইএনে। ওই রোগীদের অবসাদ বা ভুলে যাওয়ার চিকিৎসাও সেখানেই হয়।
রোগীদের সহায়তার জন্য তৈরি গোষ্ঠী হিসেবে ‘পার্কিনসন্স ডিজ়িজ় পেশেন্টস ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কলকাতা’য় সপ্তাহে এক দিন ‘বডি মুভমেন্ট’, শারীরচর্চা এবং সামাজিক মেলামেশার ব্যবস্থা আছে। ফেসবুক পেজও আছে সোসাইটির। সদস্যদের সঙ্গে নাচ-গান ও শ্রুতিনাটকে আজ, শুক্রবার রোটারি সদনে এই রোগ নিয়ে সচেতনতার মাস পালন করবে তারা। মিত্রার কথায়, ‘‘অতিমারি-পর্বে বহু রোগীকে হারিয়েছি, বহু রোগী বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছেন। এই পরিস্থিতি বদলে সচেতনতা আগে জরুরি।’’