প্রশ্ন করছে শিশুরা, জবাব নেই অভিভাবকদের কাছে। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে কেবল মহানগরীর বাসিন্দারা নন, পথে নেমেছে বিশ্ববাসী। কোথাও মিছিলে হেঁটে, কোথাও রাস্তাকেই ক্যানভাস বানিয়ে ছবি এঁকে নৃশংস ঘটনার বিচার চাইছে মানুষ। কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী থেকে রিকশাচালক, শিক্ষক থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী, বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ এই আন্দোলনে যোগদান করছেন নিজের নিজের মতো করে। রাতের পর রাত জাগছে শহরবাসী। পিছিয়ে নেই বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য থেকে খুদে সদস্যটিও। বড়দের মিছিলে পা মেলাচ্ছে শিশুরাও। মা-বাবার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে চলছে। কারও গলায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান, কারও হাতে ‘বিচার চাই’ প্ল্যাকার্ড, কেউ গানের সুরে তাল মেলাচ্ছে বড়দের সঙ্গে, কেউ আবার নাচের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে নিজের মতো করে।
চারদিকে আলোচনায় শুধুই ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, যৌন হেনস্থার মতো ভারী ভারী শব্দ। সবই চোখে পড়ছে শিশুদের। বাড়ির বড়দের নজর সারা ক্ষণ টিভির পর্দায়। শিশুর কানেও ভেসে আসছে ‘ধর্ষণের মামলার বিচার চাই’ এমন সব দাবি। বাড়ির বড়রাও সে সব নিয়ে আলোচনা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছরের আদর মায়ের কাছে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। তার প্রশ্ন, ‘‘আচ্ছা মা, ধর্ষণ কী?’’ ছোট মেয়ের কাছে এমন প্রশ্ন কোনও দিন প্রত্যাশাই করেননি বছর তিরিশের সুচিন্তা চক্রবর্তী। মেয়ের প্রশ্নের জবাবের কী উত্তর দেবেন, ভেবেই পাচ্ছিলেন না তিনি। এই সমস্যা কিন্তু সুচিন্তার একার নয়। ঘরে ঘরে এখন এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন বাবা-মায়েরা। কারও শিশু সবে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে, তো কারও শিশু পঞ্চম শ্রেণিতে, এক রকম ভাবে প্রশ্ন করছে তারা। সমস্যা কিন্তু হচ্ছে শিশুদের। কেউ মুখ ফুটে বলছে, কেউ আবার নিজের মনের মধ্যেই রেখে দিচ্ছে হাজার প্রশ্ন। এই আবহে শিশুমনে বড় প্রভাব পড়ার আগে সতর্ক হতে হবে বাবা-মায়েদের। কী ভাবে এই পরিস্থিতিতে সরল মনের শিশুদের প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন অভিভাবকেরা?
প্রতিবাদ মিছিলে মায়ের কোলে খুদে, স্লোগান দিচ্ছে সেও। ছবি: পিটিআই।
প্রতিবাদ মিছিলে শিশুদের যোগদানে আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘শিশুদের মিছিলে নিয়ে গেলে কিংবা টিভির পর্দায় সারা ক্ষণ এই ধরনের খবর চালিয়ে রাখলে তাদের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগবে, এটা স্বাভাবিক। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মতো শব্দগুলি ওদের বোঝার পক্ষে খুব কঠিন। তবে ওদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে কিংবা ওদের ভুল বোঝালে কিন্তু আরও মুশকিল। ওরা কখন, কোন পরস্থিতিতে এই শব্দগুলি ব্যবহার করে ফেলবে, বলা যায় না। এই পরিবেশে বেশি দিন থাকলে শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। টিভিতে, ইউটিউবে এই ধরনের খবর দেখে তাদের মনে ভয়েরও জন্ম হতে পারে। চারদিকে আসলে কী হচ্ছে তা তাদের কাছে বোধগম্য না হলেও খানিকটা আঁচ কিন্তু তারাও পাচ্ছে। তারাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই সময়ে অনেক শিশু স্কুলে যেতে চাইছে না, কান্নাকাটি করছে, পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না— চারপাশের পরিবেশে অস্থিরতা এর অন্যতম কারণ হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে সারা ক্ষণ টিভিতে এই ধরনের খবর চালু করে রেখে দেবেন না। কথা বলার সময় বড়দের অনেক বেশি সংযত থাকতে হবে, শিশুদের সামনে এই ধরনের কথাগুলি বার বার না বলাই ভাল। শিশু যদি এ সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন করে, তা হলে কিন্তু শিশুর বয়সের কথা মাথায় রেখে, তাদের মতো করে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বাবা-মায়েদের। তুমি বুঝবে না বলে, এড়িয়ে গেলে চলবে না। বদলে বলতে পারেন, এক জন চিকিৎসকের সঙ্গে বড় অন্যায় হয়েছে, এর জন্যই সকলে বিচার চাইতে রাস্তায় নেমেছেন। ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা নিয়ে খুব বিস্তারিত ভাবে বলার এখনই প্রয়োজন নেই।’’
নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছ’মাসের শিশুকন্যাও। স্কুলে গিয়ে কখনও আবার বাড়িতেই যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা— এমন ঘটনা আকছার উঠে আসছে খবরের শিরোনামে। তবে কোন বয়সে শিশুদের এই বিষয় সতর্ক করবেন বাবা-মায়েরা? রিমা বলেন, ‘‘ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শের তফাতটা ছোটদের স্কুলে ভর্তি করানোর আগে থেকেই বোঝানো দরকার। শিশু যখন কথা বলতে শুরু করবে, তাকে বোঝাতে হবে, এ ধরনের কোনও রকম সমস্যা হলে যেন তারা বাবা-মায়েদের এসে বলে। তবে মিছিলের ভিড়ে তাদের নিয়ে গিয়ে লাভ নেই, তাতে তাদের আতঙ্ক বাড়বে। রাস্তায় নিয়ে গিয়ে নয়, বাড়িতেই শিক্ষার পাঠ দেওয়াটা বেশি জরুরি।’’
অভিনেত্রী কণীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অভিনেত্রী কণীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে কিয়ার বয়স পাঁচ বছর। কণীনিকা বলেন, ‘‘ইদানীং দেখছি, আমার কাছে কিছু চাইতে হলে কিয়া স্লোগানের ভাষায় কথা বলছে। এটা দেখতে গেলে যেমন দুর্ভাগ্যের, তেমন আবার সৌভাগ্যেরও বটে। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওর মধ্যেও কোথাও যেন এই আন্দোলনটা ঢুকে গিয়েছে। বাড়ির ছাদ থেকে যে দিন মোমবাতি জ্বালিয়ে বিচারের জন্য স্বর তুলেছি, আমার ছেলেমেয়েও কিন্তু আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্লোগান দিয়েছে। মেয়ের সামনে টিভিতে ধর্ষণ সংক্রান্ত খবর চললে আমি কিন্তু চ্যানেল ঘুরিয়ে দিই না। আমি মনে করি পাঁচ থেকে সাত বছরে শিশুদের মস্তিষ্কে যে বীজ বপন করা হবে, তা-ই বড় হবে ভবিষ্যতে। পাঁচ বছর বয়সে ধর্ষণের মানে কিয়া বোঝে না, আমি ওকে বোঝাইওনি। তবে সমাজের পরিস্থিতি যে ভাল নয়, সেটা ও ভালই বুঝতে পারছে। মা, বাবা, দাদু, ঠাকুরমার লড়াই দেখে কিয়াও লড়তে শিখছে। সমাজ এখন যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে মেয়েদের যোদ্ধা তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই।’’
অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্র।
আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে গাঙ্গুলিবাগান থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের যে মিছিল বেরিয়েছিল সেখানে বাবার সঙ্গে মোমবাতি হাতে হেঁটেছিল অভিনেত্রী রূপাঞ্জনা মিত্রের ছেলে রিয়ান। তবে এ ছাড়া আর কোনও মিছিলে ছেলেকে নিয়ে যাননি তিনি। অভিনেত্রী বলেন, ‘‘চারপাশে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে রিয়ান ওয়াকিবহাল। তবে নিজের সঙ্গে আমি ওকে কোনও মিছিলে নিয়ে যাইনি ওর সুরক্ষার কথা ভেবে। ওর সামনে পরীক্ষা, এই সময় পড়াশোনা নিয়ে থাকাই ভাল বলে আমি মনে করি। বদলে আমি ওকে বাড়িতেই শিক্ষা দিতে চাই। টিভিতে সারা ক্ষণ দেখা যাচ্ছে শহরের কী পরিস্থিতি। ও দেখছে সেটা। তবে খুব বেশি ক্ষণ এই আলোচনা বা খবরের মধ্যে ও থাকুক সেটা আমি চাই না। রিয়ান কো-এড স্কুলে পড়ে, ওকে কিছু কিছু বিষয় আগে থেকেই শিক্ষা দেওয়া ভীষণ জরুরি। আমি ওর সঙ্গে রোজ স্কুল নিয়ে নানা রকম কথা বলি। তখন ওর কোনও কাজ ভুল মনে হলে আমি ওকে বকাবকি না করে নিজের মতো করে বুঝিয়ে দিই। ওর বন্ধুবান্ধবের বাবা-মায়েদের সঙ্গে আমি সারা ক্ষণ যোগাযোগে থাকি। সেখান থেকে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা আমার কানে এলে আমি ওর সঙ্গে সেই নিয়েও কথা বলি, ওর কী মতামত একসঙ্গে সেটাও জানতে চাই। সব মিলিয়ে আমি মনে করি, বাড়িতে সঠিক শিক্ষা পেলেই কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। মিছিলে বড়দের মাঝে ছোট শিশুদের নিয়ে গিয়ে খুব বেশি লাভ হবে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি না। ওরা ততটুকুই জানুক, যতটা ওদের বয়সে জানা দরকার।’’
মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপের মতে, এখনকার শিশুরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকে। মোহিত বলেন, ‘‘আমরা যে বয়সে গিয়ে ধর্ষণ, যৌন হিংসা কিংবা যৌন হেনস্থার বিষয় জেনেছি, এখনকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই সে সব জেনে যাই। খুদে যদি জানতে চায় যৌন হিংসা কিংবা যৌন নিগ্রহ কী, সে ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। বদলে তাদের বলা যেতে পারে কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি তার উপর শারীরিক অত্যাচার করা হয়, জোর করা হয়, তখন তাকে যৌন হিংসা বলে। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে এটি যৌন হিংসারই আর একটি ধরন, বড় হলে বুঝতে পারবে। সমীক্ষা কিন্তু বলছে, শিশুদের ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা মেয়েদের ক্ষেত্রে যতটা হয়, ততটাই কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে তাই ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যৌনতার শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। শিশু খুব ছোট হলে তাকে বোঝান, এই শব্দগুলি মানুষের উপর অত্যাচারের সঙ্গে যুক্ত। রূপকথার গল্পের উদাহরণ দিয়েও বোঝাতে পারেন। শিশুকে বলার সময়ে কোন ভাষার প্রয়োগ করছেন, সেটা মাথায় রাখতে হবে বাবা-মায়েদের। আপনি খুদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে স্কুলে গিয়ে ওরা অন্য কারও কাছে সেই প্রশ্ন রাখবে না, সেটা কে বলতে পারে?’’
ছোটদের যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা কী ভাবে দিতে পারেন বাবা-মায়েরা?
স্কুল নয়, ছোটদের যৌনতা বিষয়ক পাঠ দিতে হবে বাড়িতে, এমনটাই মত মোহিতের। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে এখন শিশুদের ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, আমি মনে করি তার মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি অঙ্গে কেউ হাত দিলে অসুবিধা আছে, আর অন্য অঙ্গে হাত দিলে অসুবিধা নেই— এটা বোধ হয় বোঝানো ঠিক নয়। যৌন অনুভূতি তো আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে। কোনও স্পর্শকে আলাদা করে দেখার তো উপায় নেই। তার বদলে যদি আমরা শিশুকে বোঝাতে পারি যে, কারও কোনও ধরনের স্পর্শই যদি তোমার খারাপ লাগে, তা হলে তুমি প্রতিবাদ করো, চোখ বড় করো কিংবা অভিবভাবকের কাছে এসে অভিযোগ করো। বাবা-মায়েদের কিন্তু এ বিষয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। শিশু এই ধরনের কোনও অভিযোগ জানালে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, তুচ্ছ ঘটনা ভেবে এড়িয়ে গেলে চলবে না।’’
দুষ্টু লোকেদের শাস্তির দাবিতে মায়ের হাত ধরে রাস্তায় শিশু। ছবি: পিটিআই
নির্যাতিতার হয়ে প্রতিবাদ মিছিলে শিশুদের নিয়ে যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে শহরবাসীর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে শিশুদের মনে এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন জাগলে তার উত্তর দেওয়ার জন্য বাবা-মায়েদের তৈরি থাকতে হবে, এমনটাই মত বেশির ভাগের। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, ওদের বয়সের কথা। খুব অল্প বয়সে যেন শিশুমনে বাড়তি চাপ না পড়ে, সেই বিষয় সজাগ থাকতে হবে বাবা-মায়েদের। শিশুর মনে প্রশ্ন আসবেই, তার উত্তর কী ভাবে দেবেন, তা পুরোটাই নির্ভর করবে বাবা-মায়েদের বিচক্ষণতার উপর।