Mental Health

করোনা আবহে মন ভাল রাখবেন? চিকিৎসকদের এ সব কথা মানতেই হবে

যাঁরা এমনিই উদ্বেগপ্রবণ, কী হবে তাঁদের অবস্থা! এত মনোরোগীর চাপ সামলানো যাবে?

Advertisement

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ১৭:০৯
Share:

করোনা আসায় মনোরোগ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ৷ সতর্ক হন আজই। ছবি: শাটারস্টক।

এবার কি মনোরোগের মহামারি? সে রকমই ভাবছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। করোনা অতিমারির হাত ধরে যে হারে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকীত্ব, অবসাদ বাড়ছে, তা রীতিমতো ভয় জাগিয়েছে তাঁদের মনে।

Advertisement

গৃহবন্দী অবস্থায় আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে মনের সব প্রতিরোধ ভেঙে গেলে, বিশেষ করে যাঁরা এমনিই উদ্বেগপ্রবণ বা অন্য মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কী হবে তাঁদের অবস্থা! এত মনোরোগীর চাপ সামলানো যাবে! এই আশঙ্কা করেছেন ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিজ্ঞানীরা। ইমারজিং ইনফেকসাশ ডিজিজ নামের জার্নালে তাঁরা জানিয়েছেন, যদিও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনের জোরে এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন,বাকিরা পারছেন না। অবিলম্বে এ দিকে নজর না দিলে বিপদ ঘটতে পারে।

ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, করোনা আসার পর মনোরোগ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ পাঁচজন ভারতীয়র মধ্যে একজন ভুগছেন মানসিক সমস্যায়!

Advertisement

কেন এমন?

"এ রকমই তো হওয়ার কথা। রাতারাতি জীবন পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্কের মানে। রোগ হলে কী হবে কেউ জানে না। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানে না। এ রকম অনিশ্চয়তার মুখে দুর্বল মনের মানুষ তো অসুস্থ হয়ে পড়বেনই।" জানালেন মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।

শুরুতে কিন্তু পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। করোনা নিয়ে হাসি-মজা হত। ভাবা হত চিনেরা সাপ-ব্যাঙ খায় তাই তাদের রোগ হয়েছে। আমাদের হবে না। কিন্তু হল। একটু একটু করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল রোগ। এসে দাঁড়াল আমাদের দরজাতেও।

আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহারে ছাড়, করোনা রুখতে পারবে ত্বকের অসুখের এই ওষুধ?

তখনও সবাই ভাবছে, আমাদের ইমিউনিটি বেশি তাই আমাদের কিছু হবে না। সে যুক্তিও ধোপে টিকল না। হু হু করে বাড়তে লাগল রোগ। ঘোষিত হল মহামারি। অতিমারি। মানতেই হল যে বিপদ এসেছে । কাটল ডিনায়াল ফেজ।

এবার হল রাগ। বিনা দোষে শাস্তি পেলে যেমন হয়, তেমন । মনে হল ষড়যন্ত্র হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস বানিয়ে কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে রাগ পড়ল চিনের উপর। তারপর ট্রাম্পের উপর। এরপর বিদেশ থেকে আসা মানুষ, অন্য রাজ্যের মানুষ, এমনকী ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও বাদ পড়লেন না। থালা বাজিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানোর পরদিনই ডাক্তার-নার্সদের পাড়া ছাড়া করার নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হল।

তাতেও কিছু হল না। বোঝা গেল দোষ-গুণ খুঁজে লাভ হবে না কোনও। তখন শুরু হল তাকে ঠেকানোর প্রচেষ্টা। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বার্গেনিং ফেজ । একদল ভগবানের কাছে হত্যে দিয়ে পড়লেন, আর যুক্তিবাদী মুক্তমনারা বিশ্বাস রাখলেন বিজ্ঞানে। হাত ধোওয়া, মাস্ক পরা, সবার থেকে দূরে থাকার নিয়মগুলি মানতে শুরু করলেন। পরিচারিক, সহকর্মী, প্রতিবেশী, সবাই দূরে সরে গেলেন। ঘরের মানুষদের সঙ্গেও বাড়ছে দূরত্ব। চেনা দুনিয়া পাল্টে গিয়েছে ক-দিনেই। গ্রাস করেছে অস্তিত্বের সংকট।

আরও পড়ুন: জ্বর হলেই করোনার ভয়? বাড়িতে রাখতেই হবে এই সব মেডিক্যাল কিট​

একে একে বন্ধ হয়ে গেল মন্দির, মসজিদ, গির্জা। আবার কিছু জায়গায় বিধি মেনে তা খুলেছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত । তাকে ঠেকানোর অনিবার্য রাস্তা বার বের করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

মাস্ক, সাবান, দামী স্যানিটাইজার ব্যবহারের সঙ্গে কেউ আবার ডাক্তারদের বারণ না শুনে খেতে শুরু করেছেন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কেউ ভাবলেন, বিসিজি নেওয়া আছে বা ম্যালেরিয়া হয়েছে বলে যদি বাঁচা যায়। আরেকটু গরম পড়লে যদি ভাইরাস মরে, এমনও ভেবেছেন কেউ কেউ।

তবে ভাইরাস রয়েছে ভাইরাসের মতো। মতিগতি কিছু বোঝা যাচ্ছে না তার। আর আক্রান্ত ও মৃতর ক্রমবর্ধমান গ্রাফ দেখে হতাশা গ্রাস করেছে। গ্রাস করেছে অবসাদ।

এবার তাহলে কী? অবসাদ কমানোর ওষুধ না অন্য কিছু? কী পরামর্শ দিচ্ছেন মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম।

তাঁর কথায়, ভাল করে বুঝতে হবে, একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। কী তার পরিণতি কেউই জানি না। কাজেই অহেতুক ভেবে লাভ নেই। বেশি ভাবলে মানসিক অশান্তি হবে। তার ছায়া পড়বে পরিবারে। এখন এই একজোট হয়ে থাকার সময়, সবাইকে অশান্ত করে তোলা কোনও কাজের কথা নয়। অসুখের প্রকোপও বাড়বে তাতে। কারণ এটা পরীক্ষিত সত্য যে মানসিক চাপ বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে।

১. দিনে একঘণ্টার বেশি খবর দেখবেন না যদি মনে তা প্রভাব ফেলে। আগে যেভাবে কাজকর্ম করে, বই পড়ে বা সিনেমা-সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতেন, এখনও সেভাবে কাটানোর চেষ্টা করুন।

২. কীভাবে সময় কাটাবেন বুঝতে না পারলে হিসেব করে দেখুন, ক-ঘণ্টা বেশি সময় পাচ্ছেন। এই সময়টা কীভাবে ভরাট করা যায় দেখুন। একটু হয়তো ব্যায়াম করলেন, ঘরের কাজ করলেন, বই পড়লেন কি সেরে নিলেন বকেয়া কাজ।

৩. নতুন শখ তৈরি করা বা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটাই আদর্শ সময়। আদর্শ সময় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়ার। পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিন। যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল, উদ্যোগ নিয়ে তাকে ভাল করা যায় কিনা দেখুন। ভালকে করে তুলুন আরও ভাল। সময় কেটে যাবে।

৪. ভবিষ্যত ভেবে আতঙ্কিত হয়ে লাভ নেই। সারা পৃথিবীর ভবিষ্যতই এখন অনিশ্চিত। যতই ভাবুন কূলকিনারা পাবেন না। কাজেই আজকের দিনটা কতটা সুন্দর, কতটা কার্যকর করে তোলা যায়, ভাবুন তা নিয়ে। কালকের কথা কাল ভাববেন।

৫. এভাবে তখনই ভাবতে পারবেন, যখন জীবনের ভাল দিকগুলি দেখার চোখ ও মন তৈরি করতে পারবেন। চাহিদা কমাতে পারবেন। আকাশচুম্বী চাহিদা মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ করেছে করোনা। এখন কী হবে না হবে সেই নিয়ন্ত্রণও প্রকৃতিরই হাতে ।

৬. আসল কথা হল, এই মুহূর্তটুকু ছাড়া আর কিছুই আমাদের হাতে নেই। কাজেই যা হাতে আছে, তাকে সুন্দর করে গড়ে নিতে হবে। যা নেই তার জন্য হা-হুতাশ করা বন্ধ করতে হবে।

৭. দুশ্চিন্তার আগে ভেবে দেখুন, এ রকম অতিমারি আগেও এসেছে। মানুষ তা অতিক্রমও করেছে। এই মহামারিও সেভাবে অতিক্রান্ত হয়ে যাবে। এখন বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নত । জীবাণুটিও যতটা ছোঁয়াচে, ততটা মারক নয় । কাজেই এই হঠাৎ পাওয়া ছুটি ভাল করে উপভোগ করতে হবে।

৮. সব কিছু করেও যদি মনে হয় সামলাতে পারছেন না, মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের সাহায্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে বাঁচতে শিখে যাবেন আপনি। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ওষুধ দিতে হতে পারে।

আগলে রাখুন বয়স্কদের

বয়স্কদের কোভিডের আশঙ্কা বেশি, সুগার-প্রেশার-হৃদরোগ ইত্যাদি থাকলে আরও বেশি, এ সব আমরা যেমন জানি, তাঁরাও জানেন। শুনছেন প্রতিনিয়ত। ফলে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। রোগ হলে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কাকে ডাকবেন? এ এমন রোগ, কাউকে তো পাশে পাওয়া যাবে না! অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে কি আসবে? বাড়ির লোকেদেরও তো বিপদ। ছেলে-মেয়ে বিদেশে, ঘরে স্রেফ বয়স্ক দুটি মানুষ, একজন রোগে পড়লে অন্যজনকে কে দেখবে?

পাশে থেকে বোঝাতে হবে বয়স্ক মানুষদের, যাতে উদ্বেগ না বাড়ে। ফাইল ছবি।

রোগী নিয়ে ছুটোছুটিই বা করবে কে? একা থাকলে তো হয়েই গেল। বাজার করতে, পেনশন তুলতে কি ওষুধ কিনতে বাইরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তখন যদি সংক্রমণ হয়! তারপর একা হাতে ঘরের যাবতীয় কাজ।

“এমনিতেই বয়স্ক মানুষের মধ্যে শতকরা ২০ জন অবসাদে ভোগেন। একাকীত্ব, উদ্বেগ, অসহায়তা মিলেমিশে থাকে তাঁদের মধ্যে। কোভিডের আতঙ্কে ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তা এক ধাক্কায় বেড়ে গেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গার্হস্থ্য হিংসা। বাড়ির লোকেদেরও তো মাথার ঠিক নেই। টেনশন ও অসহায়তার শিকার তাঁরাও। ফলে সামান্য ঠোকাঠুকিতেই বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন বয়স্করা”, এমনই জানালেন মনোচিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়।

সমাধান

পরিস্থিতির গুরুত্ব যাঁরা বুঝছেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা হবেই। অর্থবল, লোকবল না থাকলে আরও হবে। তার উপর যদি দিন-রাত কানের কাছে ঝুঁকি বেশি বলা হতে থাকে, উদ্বেগপ্রবণ মানুষের পক্ষে সে চাপ নেওয়া খুব কঠিন, যদি না তিনি নিজে ও তাঁর আপনজনেরা বিশেষ সতর্ক থাকেন।

আরও পড়ুন: মুড়ি-মুড়কির মতো প্যান্টোপ্রাজোল খান? বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি

এ ক্ষেত্রে যা বোঝাতে হবে

১. প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে ঝুঁকি বেশি থাকলেও এই মুহূর্তে সাবধানে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বয়সটাকে নিয়ে তো আর কিছু করা যাবে না, অন্য আর যা যা রোগভোগ আছে, তাদের সামলে রাখতে হবে।

২. ওষুধপত্র খেতে হবে নিয়ম করে। ওষুধের জোগান যেন ঠিক থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঠিক সময়ে ঠিকঠাক খাবার খেতে হবে। শরীর ঠিক থাকলে, মনও হালকা থাকবে।

৩. ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক-আধদিন না হলে বা কম হলে সমস্যা নেই। কিন্তু দিনের পর দিন না হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ভাল ঘুম হল দুশ্চিন্তার অব্যর্থ দাওয়াই।

৪. নতুন করে যাতে চিন্তা না বাড়ে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। চারদিকে তো এখন কোভিড ছাড়া কথা নেই। কিন্তু যাঁরা উদ্বেগ সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের জন্য এ রকম পরিস্থিতি মারাত্মক। কাজেই ঘরে এ সব আলোচনা করবেন না। তবে বয়স্ক মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন জাগলে তিনি যাতে উত্তর পান সে দিকে খেয়াল রাখুন। একেবারে কিছু না জানালেও কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ে। কাজেই ভারসাম্য মেনে চলুন।

৫. হাত ধোওয়া, একটু দূরে দূরে থাকা ও বাইরে বেরোলে মাস্ক পরার যে নিয়ম আছে, তা মেনে চলুন সবাই। বয়স্ক মানুষটিকে বোঝান যে এ সব মানলেই বিপদ কমবে।

৬. সকাল-সন্ধ্যা ছাদে একটু হাঁটাহাটি, হালকা দু-একটা স্ট্রেচিং বা যোগাসন করতে পারলে ভাল। কখন কী করা যেতে পারে তার একটা রুটিন করে নিতে হবে। ভাল লাগুক না লাগুক যখন যা করার কথা তা মোটামুটি মেনে চলতে হবে। নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে চিন্তা কম হবে।

৭. অসুখ হলে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, সে সব খবরও একটু নিয়ে রাখবেন, যদি দরকার হয়, তখন যাতে হাতড়ে বেড়াতে না হয়।

৮. যাঁরা সারাজীবন সব নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন, তাঁদের পক্ষে এই অসহায়তা মেনে নেওয়া কঠিন। তাঁদের বোঝাতে হবে যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় মানুষও তাঁর মতো অবস্থায় আছেন এখন। জীবাণুর মেজাজ-মর্জি বুঝতে পারছেন না কেউই।

৯. “যাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাস আছে, তাঁরা পুজো অর্চনা করতে পারেন। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিরূপ পরিস্থিতিতে বিশ্বাসী মানুষদের কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ-অবসাদ কম হয়”, জানালেন গৌতম বাবু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement