রথের মেলার উপকারিতা অনেক। রথ টানার ওই মেলা ভিড়ের জন্যই তো পুরীর গজপতি রাজারা বেঁচে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশরা জগন্নাথধামের ছোট্ট রাজ্যটিকে আর সরাসরি নিজেদের দখলে আনেনি, সেখানকার গজপতি রাজাদের নাম-কা-ওয়াস্তে বলবৎ রেখেছিল। রাজাকে সরিয়ে রাজ্যটি সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে আনলে আজও রথের আগে পুরীর রাজার রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার নিয়ম বলবৎ থাকত না। রাজাই নেই, তার আবার নিয়ম?
গল্পটা খুলেই বলা যাক। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তখন লর্ড ওয়েলেসলি। তুখড় যোদ্ধা, একের পর এক দেশীয় রাজ্য ছলে-বলে-কৌশলে দখল করছেন। ব্রিটিশরা ওড়িশা দখল করার পরে খুরদা ও পুরীর ছোট্ট রাজ্যটির দিকে তাঁর নজর গেল। ১৮০৪ সালের জুলাই মাসে রথযাত্রার দিন তাই বড়লাটের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে হাজির হলেন সেনাবাহিনীর কর্নেল হারকোর্ট। রথযাত্রার তুমল ভিড়ের মধ্যেই মন্দিরের পাণ্ডা, পুরোহিত ও তীর্থযাত্রীরা তাঁকে করতালিতে স্বাগত জানালেন, সোনার জলে রং করা পাতায় সংস্কৃত ভাষায় ওয়েলেসলির উদ্দেশে প্রশস্তি লিখে পাঠালেন মন্দিরের পুরোহিতরা। ওয়েলেসলিকে চিঠি পাঠালেন হারকোর্ট, ‘এখানে সকলে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে। এই পুরীর মন্দিরের গুরুত্ব তাই অক্ষুণ্ণ রাখা প্রয়োজন।’ চিঠির শেষ লাইন, ‘in a political light, its value is incalculable…’ রাজনীতির দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। রথযাত্রায় লোকারণ্য, মহা ধুমধাম না দেখলে এই বোধ হারকোর্টের আসত না।
কিন্ত যে মন্দিরে আজও বিধর্মীদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানকার জনতা কেন রথের দিন এক খ্রিস্টান সেনাধ্যক্ষকে করতালিতে স্বাগত জানাল? রথের দিন জগন্নাথ, বলরামরা তখন মাসির বাড়ি বা গুন্ডিচা মন্দির রওনা হয়েছেন, এখানে জগন্নাথ চলন্ত বিষ্ণু। জাতপাত, ধর্ম-অধর্মের বালাই না রেখে যে কেউ সেই রথের রশিতে টান দিতে পারে। আর মরাঠা আক্রমণে তার আগের কয়েক বছর সারা ওড়িশা প্রায় বিপর্যস্ত। তারা জগন্নাথ মন্দিরের দখল চায়। ব্রিটিশ সেনাই তখন মরাঠাদের পরাস্ত করেছিল।
এই পুরীর রথযাত্রার আদলেই আমাদের বাংলায় মাহেশের রথ। ১৮৭৫ সালেই বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বেরোল সেই রথের মেলার ভিড়ে এক বালিকার হারিয়ে যাওয়ার গল্প, ‘রাধারাণী নামে এক বালিকা মাহেশে রথ দেখিতে গিয়াছিল।’ লেখক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, নিজেই ওই পত্রিকার সম্পাদক, নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
এই হারিয়ে যাওয়াটা বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিক নয়! ১৮১৯ সালের ১৯ জুন ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে, ‘জগন্নাথক্ষেত্রে রথযাত্রাতে যেরূপ সমারোহ ও লোকযাত্রা হয়, মাহেশের রথযাত্রাতে তাহার বিস্তর ন্যূন নহে। এখানে প্রথম দিনে অনুমান দুই লক্ষ লোক দর্শনার্থে আসে।’ বালিকা সে দিন কী রথ দেখেছিল, কেমন লেগেছিল বঙ্কিম জানাননি। না জানানোরই কথা। শ্রীরামপুর মিশনের ওয়ার্ড সাহেব সে সময় বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘রথখানি তিরিশ হইতে চল্লিশ হাত উঁচু। রথের চাকা ষোলোখানি। জনসাধারণ রথ টানিতে টানিতে যে চিৎকার করে, তাহা এক মাইল দূর হইতে শোনা যায়। রথের গায়ে অশ্লীল মূর্তি অঙ্কিত।’ ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে, এর সঙ্গে ছিল তুমুল জুয়ো খেলা। উনিশ শতকের বাঙালি এই ভাবেই উৎসবে রথধ্বজা উড়িয়েছে।
শুধুই জুয়া? উৎসবে-ব্যসনে-বন্ধুমহলে এখন সবাই যেমন একটু ঢুকুঢুকু, রথের দিনটাও ছিল সে রকম। হুতোম তাঁর নকশায় সে আমলের কলকাতার কথা জানিয়েছেন, ‘সহরে রথ পার্বণে বড় অ্যাকটা ঘটা নাই, কিন্তু কলিকাতায় কিছু ফাঁক যাবার নয়।…মাটীর জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে। ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো মিনসেরাও তালপাতের ভেঁপু নিয়ে বাজাচ্চেন।’ নকশা এখানেই শেষ হল না। হুতোম পেঁচা আরও জানালেন, চিৎপুরের রাস্তায় দর্শকদের ভিড়ে এক মাতাল ছিল। সে ‘মা রথ, প্রণাম হই মা’ বলে প্রণাম করলে। কে বলে, বাঙালির রথ শুধু শ্রীচৈতন্যের উত্তরাধিকার? রাজধানী কলকাতায় মাতালরা রথকে মাতৃমূর্তি ভেবে গড় করতেও পিছপা হয়নি। যত রথ, তত পথ!
রাজা-প্রজা, জাত-বেজাত সকলের মেলা ভিড় প্রথম থেকেই। মিথ, ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক রাজা ব্রহ্মলোক সমান উঁচু পুরীর মন্দির তৈরি করে ব্রহ্মাকে পুরোহিত হিসেবে ডাকতে যান। ব্রহ্মা বলেন, তুমি একটু বসো। আমি সন্ধ্যা দিয়ে আসি। সন্ধ্যা দিয়ে ব্রহ্মা ফিরলেন, রাজা বললেন, ‘এ বার চলুন।’ ব্রহ্মা জানালেন, ইতিমধ্যে মর্ত্যে ৬০ হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছে, মন্দির বালিতে ঢাকা পড়েছে। ব্রহ্মলোকের কিয়ৎক্ষণ মানে মর্ত্যলোকের ৬০ হাজার বছর।
তবু ব্রহ্মা চললেন। বিষ্ণু রাজাকে কথা দিয়েছেন, তিনি ওই মন্দিরে থাকবেন। সমুদ্রে ভেসে-আসা কাঠে দারুব্রহ্ম হিসাবে, অনন্তকাল। তাঁর মহাপ্রসাদে শূদ্র-ব্রাহ্মণ ভেদ থাকবে না, সকলের সমান অধিকার। রাজা এ বার তাঁর একমাত্র কন্যা সত্যবতীর সঙ্গে জগন্নাথের বিয়ে দিলেন। সকলে ছিছিক্কার করল, ছি, কাঠের সঙ্গে মানুষের বিয়ে! এই বিয়েতেই প্রথম রথে চড়লেন জগন্নাথ, ‘ষোলশত গোয়ালাতে রথখান বহে/রথের সাজন দেখি ত্রিভুবন মোহে।’ ১৬০০ বাহক, তার সঙ্গে বিদ্যাধরদের নাচ, গন্ধর্বদের গান, মেলা লোকের ভিড়। জগন্নাথের রথযাত্রা নিয়ে
রায় রামানন্দকে এই কাহিনিই শুনিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ থেকে ওড়িয়া ভাষায় সরলা দাসের ‘মহাভারত’ সর্বত্র এই কাহিনিটিই আছে।
কিন্তু আমাদের রথের মেলা? কয়েক দশক আগেও রাসবিহারী মোড় থেকে মৌলালি অনেক জায়গায় বসত। কাঠের নাগরদোলা ঘুরত, ছুরি-কাঁচি-বঁটি, প্লাস্টিকের খেলনা... কত কী মিলত। পাওয়া যেত তেল চুপচুপে পাঁপড়ভাজা, গরম রসে ডুবুডুবু জিলিপি। তখনও মানেকা গান্ধী এবং সংরক্ষণের যুগ শুরু হয়নি। মায়ের কাছে বায়না করে রথের মেলা থেকে একটা হলদে মুনিয়া পাখি কিনেছিলাম। বাড়ি এসে স্নান করাতেই মুনিয়া পরিণত হয়েছিল চড়াইয়ে। ছেলেবেলার সেই ঠকে যাওয়া নিয়ে আফসোস নেই। এখন যে লোকে জিএসটি, আইটি-র কত শক্ত শক্ত হিসাব বোঝায়, ঠকছি কি না বুঝতে বুঝতে বছর ঘুরে যায়!
তবু মেলা বসে। বাইপাসের ধারে মুকুন্দপুর, আনন্দপুর যেখানে ফাঁকা মাঠ, সেখানেই চলে আসে ইলেকট্রিক নাগরদোলা বা ময়ূরপঙ্খী। পাঁপড় আর জিলিপির দোকানের পাশাপাশি ঝুটো ব্র্যান্ডের কিছু জামাকাপড়ের দোকান। উনিশ শতকে দীনেন্দ্রকুমার রায় পল্লিবাংলার রথের মেলা প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘অগণ্য মক্ষিকাসমাচ্ছন্ন মোণ্ডা, গোল্লা, মেঠাই, ছোট ছোট জিলিপি… নানা আকার, নানা রঙ্গের পুতুল। স্ত্রীলোকেরা কেহ ছেলেদের জন্য পুতুল কিনিতেছে, কেহ বা হাঁড়ির দর করিয়া তাহা ভাঙ্গা কি না পরীক্ষা করিবার জন্য বাজাইয়া দেখিতেছে।’ এখনও এ শহরের রথের মেলায় কম দামে স্টিলের বাসন, প্লাস্টিকের সুপারম্যান, শব্দভেদী মেশিনগান কেনা যায়। নিউটাউন আর বহুতলের ভিড়ে আচ্ছন্ন এই শহরে আজও রথের মেলা এক গোপন আনন্দবাসর। আজকাল ছোটখাটো বইমেলা, খাদ্যমেলা অনেক কিছুই হয়ে থাকে শহরে। কিন্তু কারও নেই রথারূঢ় ঐতিহ্য।
অয়ি সুন্দরী পাঠকারিণী, আধুনিকা মেয়েদের কথা কী আর বলিব! রথের দিন মেয়েদের খাওয়াদাওয়া করতে নেই, স্বামী, সন্তানের মঙ্গলকামনায় রথাইচণ্ডীর ব্রত পালন করতে হয়। রথাই ও কথাই দুই বোন। রথাইয়ের বিয়ে হল বড়লোকের সঙ্গে, কথাইয়ের স্বামী দিন আনি-দিন খাই গোছের গরিব। কথাই রথের দিন ব্রত করত, দিদিকেও বলল। কিন্তু রথাইয়ের বড়লোক স্বামী পুজোর আয়োজন ভেঙে দিয়ে, বৌ, বাচ্চাদের নিয়ে রথ দেখতে বার হল। মাঝপথে দুর্ঘটনায় হাত পা ভেঙে সকলে পড়ে রইল। কথাই ব্রত শেষ করে ছুটে গেল, পুজোর ঘট থেকে জলের ছিটে দিতে সকলে সুস্থ হয়ে উঠল। ব্রত শেষে ভাত নয়, খই ও চিঁড়ে খেতে হয়। লক্ষ্মীর ব্রত, নীলষষ্ঠীর ব্রত টিকে থাকলেও মহিলামহল থেকে রথব্রত উঠে গেল। ফুল, দেবদারু পাতা, কাগজের শিকলিতে সন্তানের রথ সাজিয়ে, নকুলদানা দিয়েই আজ এই শহরের নারীদের ব্রতকথা সমাপ্ত।
বিশ শতকের গোড়ায় এই শহরে শুরু হয়েছিল নার্সারির ব্যবসা। বর্ষাকাল, অম্বুবাচী সমাপ্ত। ফলে চিড়িয়ামোড়, রথতলা থেকে নাগেরবাজার সর্বত্র রথের মেলা থেকে কামিনী, চাঁপা, জুঁই, জবা, গোলাপ... ফুল গাছ কেনেন অনেকেই। ধূলিধূসরিত এই শহরের হরেক অলিন্দ, গবাক্ষ বা শয়নমন্দিরে তো রথের মেলাই নিয়ে আসে বহুকাঙ্ক্ষিত সবুজের অভিযান।
রথের মেলা কি শুধু কলকাতা আর শহরতলিতেই? মাহেশের রথে এলাহি আলো, ব্যান্ডপার্টির হরেক আয়োজন। আবার মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকায় বৈষ্ণব মেইতেইদের কাছে রথযাত্রা অন্যতম উৎসব। রথে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি, চামর ও হাতপাখা দিয়ে তাঁদের হাওয়া করেন দুই নারী। বিগ্রহদের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ। রথের পিছনে কেউ বাজাচ্ছে পুং বা ড্রাম, কেউ শঙ্খ, কাঁসর ও ঘণ্টা। মণ্ডপে মণ্ডপে ‘খুবাক ইসেল’ বা কীর্তন। রথযাত্রা ও মেলাশেষে রাতে সকলে মিলে পঙ্ক্তিভোজন। মণিপুর মানে শুধু মেইতেই বনাম কুকি অশান্তি নয়, ইম্ফল উপত্যকায় বর্ণাঢ্য রথের মেলা।
এই সব আনন্দমুখর রথের মেলাতেই তো জীবন, কালীদা!