মেরুদণ্ডের চিকিৎসা সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত অস্ত্রোপচারের পরে নতুন জীবন পাওয়া রোগী ও তাদের অভিভাবকেরা। রবিবার, রোটারি সদনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
অস্ত্রোপচারের পরে জ্ঞান না-ও ফিরতে পারে। এত বড় ঝুঁকির কথা কোনও ভাবে জেনে গিয়ে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি ১২ বছরের কিশোর। তবে, অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে দিদিকে বলেছিল, ‘জ্ঞান ফিরলে, তোকে সবার আগে থাম্বস-আপ দেখাব।’
বছর তিনেক আগের সেই দিনের পর থেকে এখন প্রতি মুহূর্তে নিজে এবং অন্যকে বাঁচানোর স্বপ্ন দেখে নিউ ব্যারাকপুরের বাসিন্দা স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি-তে আক্রান্ত দেবাঞ্জনগোবিন্দ মৈত্র। এই কিশোর বয়সেই অনলাইনে শেয়ার বাজারের কাজ করে সে। বাবাকে বিনিয়োগ করায় তাতে। রবিবার শহরের এক সভাগৃহে এসে দেবাঞ্জন বলল, ‘‘আমি হারিয়ে যাইনি। হেরে যাইনি। এর জন্য প্রণাম জানাই চিকিৎসকদের।’’
জিনগত রোগের কারণে মেরুদণ্ডের স্নায়ু ক্রমশ নষ্ট হচ্ছিল দেবাঞ্জনের। মাংসপেশি অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। মেরুদণ্ড পিঠের দিক থেকে বুকের দিকে বেঁকে যাওয়ায় তা চাপ দিচ্ছিল হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, অস্ত্রোপচার না করলে আয়ু এক থেকে দেড় বছর। কয়েক লক্ষ টাকার ধাক্কা কী ভাবে সামলাবেন, জানা ছিল না পরিজনদের। সেই সময়েই চিকিৎসা এবং খরচের ভাগীদার হতে এগিয়ে আসে ‘স্পাইন রিসার্চ ফাউন্ডেশন’।
এ দিন ছিল ওই সংস্থার পথ চলার ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠান। সেখানে উঠে এল, মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার মানেই শুধু দক্ষিণ ভারত নয়। বরং এ রাজ্যও পারে মেরুদণ্ডের দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করতে। আবার, এত দিন ধরে কয়েকশো দেবাঞ্জনের নতুন জীবন পাওয়ার গল্পও তাঁদের মুখ থেকেই শুনলেন দর্শকেরা। জানলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হওয়া প্রায় ৩০০ অস্ত্রোপচারে কাউকেই অর্থের কথা ভেবে পিছপা হতে হয়নি। বরং তা ভেবেছেন ‘স্পাইন রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর চিকিৎসক তথা অছি সদস্য তৃণাঞ্জন সারেঙ্গী ও সৌম্যজিৎ বসু-সহ অন্যেরা। তেমনই গল্প শোনালেন পানিহাটির বাসিন্দা টোটোচালক বাবলু দাস।
তাঁর ১২ বছরের মেয়ে রাইমার পিঠ ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি মেয়েকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানিয়ে দেন, অস্ত্রোপচারই একমাত্র পথ। বাবলু বলেন, ‘‘সাড়ে পাঁচ লক্ষ খরচ শুনে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কোনও মতে ৫০ হাজার জোগাড় করে দিয়েছিলাম। বাকিটা কী ভাবে কী হল, তা জানেন ওই ডাক্তারবাবুরা।’’ সাধারণের দানেই দীর্ঘ বছর ধরে চলছে মেরুদণ্ড সংক্রান্ত চিকিৎসার ওই সংস্থা। যেখানে মেরুদণ্ড সংক্রান্ত গবেষণা, প্রশিক্ষণের সুযোগও রয়েছে। অর্থোপেডিকে এমএস এবং স্নায়ু শল্যে এমসিএইচ পাশ করা চিকিৎসকেরা ওই সংস্থা থেকে ফেলোশিপ করতে পারেন। তার জন্য এন্ট্রান্স ও এগজ়িট দু’টি পরীক্ষা দিতে হয়।
তৃণাঞ্জন বলেন, ‘‘এখান থেকে ফেলোশিপ করে ৫০ জনের বেশি স্পাইন সার্জন সারা দেশে পরিষেবা দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতেরও বাসিন্দা রয়েছেন।’’ তিনি আরও জানান, মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচারের সংখ্যার দিক থেকে দেশে দু’নম্বরে রয়েছে এই সংস্থা। বিভিন্ন জেলা তো বটেই, বাংলাদেশ থেকেও রোগীরা আসেন স্পাইন রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। সৌম্যজিৎ জানাচ্ছেন, জন্মগত, বয়ঃসন্ধির সময়ে কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে ‘স্কোলিয়োসিস’ (মেরুদণ্ড ‘এস’ বা ‘সি’-এর মতো বেঁকতে শুরু করে) দেখা যায়। সব সময় যে অস্ত্রোপচার বাধ্যতামূলক, তা কিন্তু নয়। সমস্যা তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করা গেলে বহু ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষণে রেখে দেখা যায়, শিশুটি সুস্থ হল।
এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ, স্নায়ুরোগ চিকিৎসক ইন্দ্রজিৎ রায়, চিকিৎসক তথা পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অস্থি রোগ চিকিৎসক ইন্দ্রজিৎ সর্দার, অভিনেতা বিপ্লব দাশগুপ্ত-সহ অনেকে। তাঁরা বলছেন, ‘‘মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার মানেই বড় বিপদ ঘটবে, এমন ভ্রান্ত ধারণা বেশির ভাগ মানুষের। আসলে এই অস্ত্রোপচার দলগত কাজ।’’
সেই দলগত সাফল্যের প্রতিচ্ছবিই দেবাঞ্জনেরা। দেবাঞ্জনের আবৃত্তি শুনে স্টিফেন হকিংয়ের প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার শেষ লাইন, ‘অসুখ তোমাকে ধন্যবাদ/তুমি আমার জেদ সীমাহীন করেছো’ তুলে ধরেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। সব শেষে ছিল মেরুদণ্ডের বিকৃতিকে জয় করে এক বালিকার অভিনেত্রী হয়ে ওঠার নাটক, ‘আলোর দিশা’। আর সেই চরিত্রটি মঞ্চস্থ করলেন, বছর কয়েক আগে অস্ত্রোপচার হওয়া এক তরুণী।