এক বার এক সাক্ষাৎকারে পিলে চমকানো এক ‘সহজ হিসেব’ শুনিয়েছিলেন ব্রায়ান ক্রজ়নিক। মার্কিন মাইক্রোচিপ বহুজাতিক ‘ইনটেল’-এর এই প্রাক্তন কর্ণধার বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে প্রথম যে চিপ ইনটেল তৈরি করেছিল, তার তুলনায় ২০১৫ সালে বাজারে আনা প্রসেসর ৩,৫০০ গুণ দক্ষ। তা চালাতে বিদ্যুৎ লাগে ৯০,০০০ ভাগের এক ভাগ। আবার, সেই মাপকাঠিতে তার দামও আগের চিপের ৬০,০০০ ভাগের এক ভাগ!
শুধু মাইক্রোচিপই যদি গত কয়েক দশকে এতখানি পাল্টে থাকে, তা হলে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে কী আমূল বিপ্লব ঘটে গিয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, কম্পিউটার থেকে ক্লাউড কম্পিউটিং, মোবাইল থেকে ইন্টারনেট সংযোগ— বদলে গিয়েছে সবই। ফলে ওই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যাঁদের কাজ-কারবার, সেখানে চাকরিই যাঁদের রুজি-রুটি, তাঁদের কত তাড়াতাড়ি নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়, গোড়াতেই সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা ভাল। আজকের সফটওয়্যার কালকে অচল। তথ্যপ্রযুক্তির চাকরি বললেই বিদেশে কাজ করতে যাওয়া কিংবা মোটা বেতনের হাতছানি হয়তো চোখের সামনে ভাসে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ওই চাকরিতে সসম্মানে টিকে থাকার প্রথম শর্ত নিজেকে ক্রমাগত বদলাতে পারার ক্ষমতা।
কাজের রকমফের
একই ফুটবল টিম বলে তো আর গোলকিপার এবং স্ট্রাইকারের কাজ এক নয়। ঠিক তেমনই, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও যিনি কল সেন্টার (বিপিও) কর্মী আর যিনি কাজ করেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, তাঁদের দায়িত্বের বৃত্ত আলাদা। এখানে আমরা কথা বলছি মূলত ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে। এঁদের কেউ হয়তো সফটওয়্যার কোডিংয়ে কাজ করেন, কেউ টিম লিডার হিসেবে বুঝে নিতে চেষ্টা করেন ক্লায়েন্টের নানা বায়নাক্কা।
ডিগ্রি বৃত্তান্ত
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে সাধারণত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি (বি টেক) জরুরি। এমন নয় যে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েই পড়তে হবে। ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল, মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সমেত বিভিন্ন বিষয়ে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের দেখা মিলবে আইবিএম, টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো-র মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলিতে ঢুঁ মারলেই। ছাত্রছাত্রীরা কোথা থেকে কেমন নম্বর (সিজিপিএ) নিয়ে পাশ করছে, তা প্রথম চাকরি পাওয়া এবং তার বেতন ঠিক হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আইআইটি এবং ক্রম তালিকায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকা কোনও কলেজের দু’জন একই সংস্থার একই প্রোজেক্টে একই সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, কিন্তু তাঁদের বেতন সমান হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পরে এই বেতন মূলত নির্ভর করে প্রমাণিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপরে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি অনেক সময়ে বিভিন্ন প্রোজেক্টে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি টেক বা এমসিএ পাশ করা পড়ুয়াদেরও নিয়ে যায়।
কাজের ধরন
বিশ্বের তাবড় বহুজাতিক কিংবা দেশের বড় সংস্থাগুলি তো বটেই, এখন অনেক মাঝারি মাপের সংস্থাও তাদের ব্যবসার প্রযুক্তিগত দিকটি সামলানোর কাজ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপরে ছেড়ে দেয়। যেমন, কোনও ব্যাঙ্কের পুরো ‘ব্যাক-এন্ড অপারেশন’ সামলানো কিংবা কোনও ইস্পাত নির্মাণ সংস্থার কর্মীদের বেতন এবং ছুটির হিসেব ‘আপডেটেড’ রাখার দায়িত্ব এমন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির কাছেই এসে থাকে। সাধারণত, এ ধরনের হাজারো কাজের জন্যেই কর্মীদের নিয়োগ করে সংস্থাগুলি। তাই ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ, বরাত দেওয়া সংস্থা কী চায় বুঝে নিয়ে, সেই ‘সলিউশন’ তাদের জোগানো। অনেক ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এবং ক্রমাগত তার মানোন্নয়নের দায়িত্বও তাদের। তাই ক্লায়েন্ট সংস্থাকে সলিউশন জোগানোর পাশাপাশি তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলাও এই কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সফট স্কিল
সম্ভবত এই কারণেই প্রযুক্তিগত দক্ষতার (সফটওয়্যার ল্যাঙ্গোয়েজে জ্ঞান, কোডিং ইত্যাদি) পাশাপাশি চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময়ে বিভিন্ন সফট স্কিলও পরখ করে দেখে নেয় সংস্থাগুলি। মেপে নেয় যে, চাকরিপ্রার্থী ইংরেজি বলা ও লেখায় কতখানি সড়গড়, ক্লায়েন্টের সামনে গুছিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করতে তিনি কতখানি স্বচ্ছন্দ, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা তাঁর আছে কি না।
জরুরি কিছু কথা
• ছাত্র বা ছাত্রী কোথা থেকে কেমন নম্বর (সিজিপিএ) নিয়ে পাশ করছে, তা কিন্তু প্রথম চাকরি পাওয়া এবং তার বেতন ঠিক হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
• চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতার (সফটওয়্যার ল্যাঙ্গোয়েজে জ্ঞান, কোডিং ইত্যাদি) পাশাপাশি বিভিন্ন সফট স্কিলও পরখ করে দেখে নেয় সংস্থাগুলি।
• যারা অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে আরও ভাল কাজের সন্ধানে, তাদের সবার আগে দেখতে হবে, চাহিদা তৈরি হচ্ছে কোন ক্ষেত্রে।
এখন বাজার
কোভিডের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি বেসামাল। বিশেষত ধুঁকছে বিমান পরিবহণ, পর্যটন, হোটেলের মতো বিভিন্ন শিল্প। তার আঁচ লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও। দেশ-বিদেশের বহু সংস্থা আপাতত খরচ ছাঁটাইয়ের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প তাকে তুলে রেখেছে। তাই বরাত কমেছে। এমনকি, চাকরি খুইয়েছেন বহু মানুষ।
তেমনই আবার চাহিদা বেড়েছে মোবাইল পরিষেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, অনলাইন পড়াশোনার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ওই সমস্ত ক্ষেত্রের কাজে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের চাহিদা রয়েছে। এখন ধীরে হলেও মুখ তুলতে শুরু করেছে আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনীতি, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির ৭০-৮০ শতাংশ ব্যবসাই আসে যেখানকার সংস্থাগুলি থেকে। ফলে অস্তিন গুটিয়ে তৈরি হওয়ার সময়ও কিন্তু এখনই।
কী করণীয়
যারা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ো, তাদের যদি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তা হলে প্রথম কর্তব্য জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া। মনে রাখা দরকার, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাপ কিন্তু সারা জীবনের জন্য দামি।
যারা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে, তাদের ভাল নম্বর পাওয়ার চেষ্টা আর প্রযুক্তিগত দক্ষতায় শান দেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি লেখা ও বলায় জোর দেওয়া উচিত। কথার আদানপ্রদানে যতটা সম্ভব সাবলীল হওয়া দরকার।
আর যারা অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে আরও ভাল কাজের সন্ধানে আছে, তাদের সবার আগে দেখতে হবে যে, চাহিদা তৈরি হচ্ছে কোন ক্ষেত্রে, সব থেকে বেশি কদর কোন দক্ষতার। এখন স্পেশালাইজ়েশনের যুগ। দেশের অগ্রণী এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্ণধার সম্প্রতি দাবি করেছেন, কাজ আউটসোর্সিংয়ের বিষয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বহু সংস্থার মধ্যে গত কয়েক বছরে কিছুটা সংশয় এসেছিল। কিন্তু কোভিডের আক্রমণে আর ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর বাধ্যবাধকতায় সেই ছবি দ্রুত বদলাচ্ছে। ফিরে আসছে ‘আউটসোর্সিং’-এর স্বাচ্ছন্দ্য। ফলে আগামী দিনে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে, বরাত ফুলেফেঁপে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী তিনি।
যেন সাইকেল
মোটা বেতন, সামাজিক সম্মান ইত্যাদির টানে মেধাবী পড়ুয়াদের অনেকেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দিকে ঝোঁকেন। এ কথাও ঠিক যে, এ কাজে নিত্যনতুন সমস্যার সমাধান খোঁজার চ্যালেঞ্জ আছে। রয়েছে তথ্য ও যুক্তি (ডেটা ও লজিক) নিয়ে ‘খেলা’ করার সুযোগ। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, এই চাকরি অনেকটা যেন দু’চাকার সাইকেল চালানোর মতো। যেখানে মাটিতে পড়ে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার একমাত্র শর্তই হল ক্রমাগত প্যাডেল করে চলা। নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে ক্রমাগত মানিয়ে চলতে হবে নিজেকে। সেটা অটোমেশন বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং হোক বা রোবোটিক্স— অনেক কিছুই হতে পারে।
সেই নতুন বিদ্যায় ধাতস্থ হতে অনেক ক্ষেত্রে সংস্থাই মাস তিনেকের প্রশিক্ষণ দেয়। সফল ভাবে তা আত্মস্থ করতে পারলে, জমাটি প্রোজেক্ট জুটতে পারে। তেমনই, খেই হারালে আসতে পারে ছাঁটাইয়ের চিঠিও!
এক তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকের উচ্চপদস্থ কর্তা সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এই দুনিয়া একই সঙ্গে আকর্ষণীয় আর নির্মম। হেলায় ক্রমাগত ট্রাপিজ় বদলে যেতে স্বচ্ছন্দ হলে, এই সার্কাসে আপনি স্বাগত।”