ওই কাঁটা কাঁটা গোল্লামতো ভাইরাসটি তো ঢুকছে কিছু লোকের শরীরে, চিকিৎসায় বেশির ভাগই সেরে উঠছেন। কিন্তু সে আমাদের মনকেও এমন এলোমেলো করে দিচ্ছে কী ভাবে?
কেরিয়ারের অনিশ্চয়তার জন্য কাউন্সেলিং চেয়ে ফোন করেছিল কলেজপড়ুয়া শ্রীময়ী। কিন্তু ক্রমশ বোঝা গেল, তার জীবনের বিশেষ দু’টি ভালবাসাকে হারানোর ভয় তাকে কুরে খাচ্ছে। এক জন তার ডায়াবেটিক বাবা, জরুরি পরিষেবার কর্মী বলে কাজে যেতে হচ্ছে, শ্রীময়ী সারা ক্ষণ ভয়ে থাকে। দ্বিতীয় জন তার বয়ফ্রেন্ড, তার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, শ্রীময়ীর আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করে না।
দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িতে ড্রাইভারের কাজ করতেন প্রৌঢ় অনন্তবাবু। এপ্রিল মাসে কাজ গিয়েছে। আপাতত রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের অনিয়মিত কাজ করছে তাঁর কিশোর ছেলে বাবলু। বাবলুর সরকারি স্কুলে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে বটে, আছে একটা মোবাইলও, তবু তার পড়াশোনার উৎসাহ আর সময়, দুইয়েরই অভাব হচ্ছে। উপরন্তু হচ্ছে ছোটখাটো নেশার অভ্যাসও।
জাভেদ ব্যাঙ্ককর্মী। শহরতলির ফ্ল্যাটবাড়িতে স্ত্রী, আট বছরের ছেলে রাজা, বৃদ্ধ বাবা-মা। জাভেদের হল করোনা। হাসপাতালে ভর্তিও হতে হলেন। জাভেদের রোগের সময় তাঁর পরিবারকে হেনস্থা হতে হয়েছে ফ্ল্যাটের কিছু লোকের কাছে। এক দিন কোনও ভাবে ফ্ল্যাটের সামনের ল্যান্ডিংয়ে বেরিয়ে পড়ায় রাজাকে শুধু বকাবকিই করেননি, ফোন করে জাভেদের স্ত্রীকে প্রায় হুমকি দিয়েছিলেন এক প্রতিবেশী। সেই হুমকিতে উল্লেখ ছিল জাভেদের ধর্মেরও। অত হাসিখুশি ছেলেটা এখন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ফ্ল্যাটের কাউকে দেখলে ভয় পায়, বাড়িতে মেজাজ দেখায় বেশি, মোবাইলে মুখ গুঁজে ভিডিয়ো গেম খেলতে চায় সারা ক্ষণ।
প্রস্তুতিহীন অনিশ্চয়তা
অনন্তবাবুর মতো সাধারণ শ্রমিক থেকে কর্পোরেট, সকলেরই জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা। শ্রীময়ীর মতো অল্পবয়সিরা পরস্পরবিরোধী খবরে বিভ্রান্ত। একঘেয়েমি, বিষাদ আচ্ছন্ন করছে অনেককে। দাঁত-নখ বার করছে হিংস্রতা, রাজা যার শিকার।
কয়েক দশক ধরেই আমাদের শহরে, মধ্যবিত্ত জীবনের মানে ছকে বাঁধা কেরিয়ারের সাফল্যের সংজ্ঞায় ঘোরাফেরা করছে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদার দ্রুত জোগান ধৈর্য কমিয়ে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিকতার মানেটাই দিয়েছে পাল্টে। হঠাৎ এই কোভিড-১৯ এসে ছিঁড়েখুঁড়ে দিল আমাদের চেনা ছক। রোগটা যত না প্রাণঘাতী, আমরা ভয় পাচ্ছি তার চেয়ে অনেক বেশি, তার অনেকটা কারণ অবশ্যই এই অভ্যস্ত নিশ্চিন্তি হারানো।
কোভিড-কালে সমস্যা
কোভিড-কালের মানসিক অসুবিধেগুলো একটু আলোচনা করি।
• উদ্বেগ ও বিষাদ: উদ্বেগ বিষয়টাই কিছুটা কল্পনাভিত্তিক। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একটা কালো ছবি আমরা মনে এঁকে নিই। স্বভাবতই কেউ সহজে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, কেউ বেপরোয়া, কেউ সব ব্যাপারেই চিন্তাগ্রস্ত, কেউ বিশেষ বিশেষ বিষয়ে। যেমন, অনন্তবাবু রোজগার, শ্রীময়ীর কেরিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক। বিষাদের প্রধান লক্ষণ কিছু ভাল না লাগা। কান্না পাওয়া, অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম আর খিদে, খিটখিটে ভাবও বিষাদের লক্ষণ। প্যান্ডেমিকের ফলে যে উদ্বেগ ও বিষাদ, তা কিন্তু সরাসরি রোগ বিষয়ে না হয়ে দৈনন্দিন খিদে ও ঘুমের সমস্যা, বিরক্তি, শারীরিক সমস্যার রূপ ধরেও আসতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে বার বার শরীর খারাপ, জেদ এ সবও হতে পারে।
বহু ক্ষেত্রেই উদ্বেগ আর বিষাদ একসঙ্গে চলে। তাই এই লক্ষণগুলির বাড়াবাড়ি হলে পেশাদারি সাহায্য নিলে ভাল হয়।
• সম্পর্কের সমস্যা: লকডাউনে সারা পৃথিবীতে বেড়ে গিয়েছে পারিবারিক অশান্তি, শিশু ও নারীদের উপর নির্যাতন। যেখানে পুরুষেরা প্রধান রোজগেরে, সেখানে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে হীনম্মন্যতা। নিজের অসহায়তার রাগ প্রকাশ পাচ্ছে স্ত্রী বা সন্তানের উপরে। পারিবারিক অশান্তির সবচেয়ে কুপ্রভাব পড়ে শিশুদের উপর।
সমাধানের পথ
প্যান্ডেমিকে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে সচেতন সারা পৃথিবী। আমি বলব না, শ্রীময়ী-রাজা-অনন্তবাবুদের সাহায্য করার মতো নিশ্চিত জবাব মনস্তত্ত্বে আছে, তবে এটুকু বলাই যায় যে মানসিক ভাবে ভাল থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল আনা। আলোচনা করব, কী ভাবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখব।
• আলোচনা সীমিত থাকুক: সারা দিন রোগের আলোচনা করলে, জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোকে অবহেলা করলে, মানসিক রোগ বাসা বাঁধতে পারে। তবে একেবারে বেপরোয়া হলেও বিপদ। তাই প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিয়ে সরকারি নীতি মেনে যথাসাধ্য স্বাভাবিক কাজকর্মের চেষ্টা করা দরকার।
• সৃজনশীল কাজের চর্চা: প্রত্যেকের মধ্যে নতুন ভাবে কিছু করার ক্ষমতা আছে— গান, নাচ, লেখালিখি, রান্না বা হাতের কাজ। গোটা পরিবার একসঙ্গে খেলাধুলো, সিনেমা দেখা, বই পড়া কিংবা সৃজনশীলতা চর্চার আনন্দে কাটুক না এই কোভিড-কাল! বড়রা বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারে সেই সব দিকগুলির কথা ভাবতে পারেন, যার সাহায্যে তাদের কাছে পড়াশোনাটা আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে।
• প্রকৃতি আর পশুপাখির কাছাকাছি: মনের জট খুলে দেওয়ার এমন সহজ থেরাপি খুব কমই আছে। মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে অবসর কাটুক আকাশ দেখে, পাখি আর কাঠবেড়ালির সঙ্গে গল্প করে, ছোট্ট জায়গায় গাছের যত্ন করে। একটা সবুজ জীবনকে নিজের হাতে তৈরি করার আনন্দ বেঁচে থাকার মানে বয়ে আনুক আমাদের জীবনে।
• শারীরিক ও মানসিক কসরত: বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম, মর্নিং ওয়াক, যোগব্যায়াম খুবই উপকারী। মনের ব্যায়াম হল, পছন্দের কাজ, সৃজনশীলতা আর মনঃসংযোগ বা ধ্যান।
• পারস্পরিকতা: জাভেদের প্রতিবেশী ভয়েই হয়তো কুৎসিত ব্যবহার করেছিলেন। জাভেদের কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সেই প্রতিবেশীর নীচতা তাঁকেও কি নিজের ও অন্যের কাছে ছোট করে দেয়নি? তা-ই শুধু নিজের নয়, আমরা যেন খেয়াল রাখি আশপাশের মানুষগুলিরও। অনিশ্চয়তা সবার জন্যই সমান। ভালবাসার চেয়ে বড় মানসিক সম্পদ আর কিছু নেই। কোভিড-কাল হোক ভালবাসাকে জাগিয়ে রাখার প্র্যাকটিসের সময়।
অনিশ্চয়তাকে গ্রহণ করে সুস্থ থাকা সহজ হবে ভালবাসা, মনোযোগ, প্রকৃতিপাঠ আর সৃজনশীলতার চর্চা করলে। শারীরিক দূরত্বকে ভুলিয়ে দিক মানসিক নৈকট্য, অবসাদ ও উদ্বেগকে মুছিয়ে দিক আনন্দচর্চা। বিদ্বেষের বীজ যদি মাথা তুলতে চায়, তাকে উপড়ে ফেলার এ-ই তো সময়।
অধ্যাপক, ফলিত মনোবিজ্ঞান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়