এক অদ্ভুত শূন্যতার মধ্যে দিন-সপ্তাহ-মাস কাটছে ছাত্রছাত্রীদের। কেউ স্কুলে পড়ে, কেউ স্কুলপর্ব শেষ করে পরের ধাপের জন্য পা ফেলবে, কেউ পড়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ তারও একদম শেষ ধাপে। মহামারির অভিঘাত সব স্তরের ছাত্রছাত্রীদেরই ঠেলে দিয়েছে এক অপ্রত্যাশিত অনিশ্চয়তার গহ্বরে। স্কুলকলেজ শিকেয়, কবে পরীক্ষা হবে তার ঠিক নেই, পরীক্ষা হবে কি হবে না, তাই নিয়ে ঘন ঘন কর্তৃপক্ষের ভোলবদল, তার মধ্যে একটা হ য ব র ল পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্বটা এ বারের মতো সাঙ্গ করা হল। পরের ধাপে ভর্তির কোনও ছবি স্পষ্ট নয়, যে সমস্ত প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে একটা দীর্ঘ লড়াই বা প্রস্তুতি চলে, সেগুলোও খানিকটা মরীচিকার মতো পিছিয়ে চলেছে। ভাল সুযোগের জন্য অন্য শহরে বা অন্য দেশে পড়ার পরিকল্পনা আপাতত বিশ বাঁও জলে।
এরই মধ্যে শহরাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের অনলাইন পড়াশোনার হইচই চলছে। তার ধাক্কায় একটা ফোন বা কম্পিউটারে ঘাড় গুঁজে অনেকেই কিছুটা বেসামাল হওয়ার জোগাড়। কিন্তু শহর একটু ছাড়ালেই এ সব ফিকে হতে শুরু করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাড়িতে অনলাইন পড়াশোনার কোনও পরিকাঠামো নেই, তার ব্যবস্থা করার আর্থিক সামর্থ্যও নেই। শুধু ভারত কেন, এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু দেশে একই ছবি।
প্রত্যেকেই মাসের পর মাস চার দেওয়ালের মধ্যে একা একা আটকে। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে পারা ছাড়া একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থান, এবং এর অবসান কবে, তার উত্তরও কারও কাছে নেই। এই আটকে পড়া বিভিন্ন বয়সি পড়ুয়াদের সংখ্যা ভারতে আনুমানিক ৩২ কোটি; ইউনেস্কো-র হিসেব অনুযায়ী, সারা পৃথিবী জুড়ে ১৯১টি দেশে প্রায় ১৫৭ কোটি। খুব ছোট ছেলেমেয়েদের কথা বাদ দিলে, যারাই নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা শুরু করেছে সকলেই কম-বেশি হতাশার শিকার বলেই মনে হয়। সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান, অর্থনীতির সঙ্কট, জীবিকার অনিশ্চয়তা, পড়াশোনার বাধা, পরীক্ষা হবে কি না সেই তর্কবিতর্ক— এ সবের মধ্যে যে আলোচনাটা সবচেয়ে কম হচ্ছে তা হল বিশ্বব্যাপী তরুণ প্রজন্মের অনন্ত অসহায়তা ও তাদের মনের ওপর এর তীব্র অভিঘাত। অল্পবয়সিদের কাছে এই সমস্যা বিশেষ গুরুতর, কেননা তারা এখনও জীবনের চড়াই-উতরাই সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়।
যারা ভাবছ আমার বেলাতেই কেন এমন হল— তাদের এটাই বলার যে দুনিয়ার পরিসংখ্যানটার দিকে এক বার চোখ রাখো। আজ তোমার মতো অবস্থায় দুনিয়া জুড়ে ১৫০ কোটিরও বেশি ছেলেমেয়ে, এটা মাথায় রাখলেই বুঝতে পারবে যে করোনা-সঙ্কট কেন মানবসভ্যতায় একটা নির্ণায়ক সময়। যে ভাবে পড়াশোনা বা আগামী জীবনের জন্য তোমরা প্রস্তুত হতে দেখেছ সবাইকে, এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাতে অনেক পরিবর্তন আসতে চলেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যে ভাবে চলে, বা পরীক্ষা যে ভাবে হয়, সেটা হয়তো আগামী বেশ কিছু দিন আর আগের মতো থাকবে না। নতুন কোনও পদ্ধতির সঙ্গে সকলকে মানিয়ে নিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের যেমন, শিক্ষকদেরও তেমন। কোনও পক্ষেই ব্যাপারটা সহজ নয়, কারণ সকলকেই তার চেনা ছন্দের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রেখো, যে হেতু এই সঙ্কট দুনিয়াব্যাপী, তাই তুমি তোমার সমবয়সি সকলের সঙ্গেই এক নৌকার যাত্রী। এই পরিস্থিতিতে তোমাকে ভাবতে হবে, পড়াশোনা বা কর্মজীবনের এই নতুন পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কী ভাবে নিজেকে তৈরি করা যায়। যে সেটা যত ভাল পারবে, সে তার সমবয়সিদের তুলনায় ততটা নিরাপদ পরিস্থিতিতে থাকবে।
প্রথমেই দরকার, নিজে নিজে পড়াশোনা করার জন্য মনের জোর। ছোট থেকেই যে হেতু শিক্ষকেরা পড়াশোনার গতি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন, তাই তার থেকে বেরিয়ে এসে একটা ছক করে নিজে পড়তে পারার মানসিক শৃঙ্খলা অত্যন্ত জরুরি। আপাতত প্রতি দিন বা প্রতি সপ্তাহে শিক্ষক সশরীরে তোমার পড়া দেখে দিতে পারবেন না, তবু পড়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই স্কুল-কলেজের রুটিনের মতো বাড়িরও একটা রুটিন করে নাও, কখন কী পড়বে। যাদের ইন্টারনেটের সুবিধে আছে, তারা ওই রুটিনের মধ্যে অনলাইন কিছু পড়াশোনাও ঢুকিয়ে ফেলো— বিভিন্ন বিষয় ভাল করে শিখতে পারার অজস্র সম্পদ ছড়িয়ে আছে সেখানে। এ ছাড়া পছন্দের নানা বিষয়ে বই পড়ার চেষ্টা করো, ছাপা বই হোক বা ই-বুক। এ ছাড়াও অন্য শখ থেকে থাকলে সেগুলোয় একটু সময় দাও— গান-বাজনা, ছবি আঁকা ইত্যাদি। এমনি সময়ে পড়ার চাপে অনেক কিছুই হয়ে ওঠে না, কিন্তু এই চর্চাগুলো নেহাত লকডাউনে সময় কাটানো নয়, এক জন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে তোমাকে। উচ্চশিক্ষা বা চাকরির আবেদনের সময় দেখবে, পড়াশোনার নম্বরের থেকেও এই দক্ষতা বা শৈলী তোমাকে অন্যের থেকে আলাদা করে দেবে।
যারা জীবিকা শুরু করার মুখোমুখি এসে গিয়েছ, তাদের মনে রাখতে হবে যে অর্থনীতি বা বাণিজ্যের জগতে পৃথিবী জুড়ে ভূকম্পন ঘটিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। তাই পুরনো ছক অনেক ক্ষেত্রেই আর মিলবে না, সুযোগের ক্ষেত্রগুলোও ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কোন সুযোগ এখন তোমার সামনে আসবে, সেটা তোমার হাতে নেই। কিন্তু যেটা খানিকটা হাতে আছে, তা হল নিজেকে তৈরি রাখা। তোমার যেটা মূল বিষয়, তাতে পড়াশোনা বাড়াও, এই লকডাউনে আবার সব ঝালিয়ে নাও। আর সেই বিষয়ের বাণিজ্যিক দিকগুলো ভাল করে বুঝে নেওয়ার জন্য অনলাইনে একটু সময় কাটাও।
চাকরি ক্ষেত্রে কথা বলা বা অন্যের সঙ্গে সংযোগের গুরুত্ব নিয়ে অনেক কথাই আমরা আগে বলেছি, কিন্তু এখন তার প্রয়োজন আরও বাড়বে। যে হেতু অধিকাংশ কাজ এখন বাড়ি থেকে হচ্ছে, ফোনে বা ভিডিয়ো কলে কথা বলেই সংযোগ রক্ষা করতে হবে, সামনাসামনি কথা বলার থেকে সেটা অনেকাংশেই আলাদা। তার জন্য হয়তো নিজের বায়োডেটারও ভিডিয়ো বানাতে হবে, যাতে নির্বাচনকারী তোমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটা আন্দাজ পেতে পারেন। হতেই পারে, তোমার প্রথম চাকরিতে তোমাকে বাড়ি থেকেই কাজ করতে হবে। সেটা সহজ নয়। স্কুল-কলেজে বা অফিসে আমরা যখন যাই, শরীরের সঙ্গে মনটাও তখন সেই আবহে গিয়ে পড়ে। এখন তুমি থাকছ বাড়ির পরিবেশে, কিন্তু মনটাকে নিয়ে যেতে হবে ক্লাসরুমে বা অফিসে— এর জন্য মনের শৃঙ্খলা লাগবে, অনুশাসন লাগবে। এটা যে যতটা ভাল ভাবে করতে পারবে, তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক বৈষম্য অনেক। ফলে সকলের হাতে সুযোগসুবিধাও সমান নয়। তোমাদের অনেকেরই হয়তো সুযোগের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু মনে রেখো, তার মধ্যেও নিজের প্রস্তুতিতে মন দিতে হবে, যার হাতে যেটুকু সুযোগ তার যথাসম্ভব ব্যবহার করতে হবে। গত এক শতকে এগিয়ে চলা মানবসভ্যতার ছন্দকে নাড়িয়ে দেওয়া এই মহামারি এখন সকলের সামনেই নিজেকে নতুন করে তৈরি করার একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।