মুম্বই মনতাজ

হেরে গেল, নাকি জিতে গেল?

শক্তি ফিল্মসের শুটিং। পরিচালক শক্তিদার (সামন্ত) এক পুত্র অসীমের পাশের চেয়ারে বসে আছি। হিন্দি ছবির অবশ্য অঙ্গ হিসেবে ‘নাচা-গানার’ দৃশ্যগ্রহণ চলছে। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন নর্তকীর তালে তালে নৃত্য। ব্যাকগ্রাউন্ডে গীত-বাদ্য চলছে। লুপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মহড়ার পর মহড়া এবং নৃত্য পরিচালক সরোজ খানের মনোমতন হলে— “টেক”। সেকেন্ড শিফটের শুটিং। দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। দু’টি ‘টেক’ হতে বিকেল চারটে সাড়ে চারটে বেজে গেল। উঠি উঠি করছি। রতন পল বা পাল এসে হাজির।

Advertisement

মিলন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১০
Share:

শক্তি ফিল্মসের শুটিং। পরিচালক শক্তিদার (সামন্ত) এক পুত্র অসীমের পাশের চেয়ারে বসে আছি। হিন্দি ছবির অবশ্য অঙ্গ হিসেবে ‘নাচা-গানার’ দৃশ্যগ্রহণ চলছে। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন নর্তকীর তালে তালে নৃত্য। ব্যাকগ্রাউন্ডে গীত-বাদ্য চলছে। লুপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মহড়ার পর মহড়া এবং নৃত্য পরিচালক সরোজ খানের মনোমতন হলে— “টেক”।

Advertisement

সেকেন্ড শিফটের শুটিং। দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা। দু’টি ‘টেক’ হতে বিকেল চারটে সাড়ে চারটে বেজে গেল। উঠি উঠি করছি। রতন পল বা পাল এসে হাজির। বেশ স্মার্ট। সব স্তরেই চেনাজানা। যে কোনও স্টুডিও চত্বরে, সিনেমা পাড়ায় পল বেশ মিশুকে ও মজাদার বলে সবখানেই ও পাত পায়। বয়েস আন্দাজে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের যে কোনও জায়গায় হতে পারে। গোঁফ-দাড়ি নিখুঁত কামানো চুলে কলপ।। কাছে বসলে বেশ ফুরফুরে আতরের গন্ধ। সব মিলিয়ে মিশিয়ে বোঝা কষ্টকর নয় যে মানুষটি বেশ শৌখিন। চাকরি করে না। প্রেস-ট্রাস্ট ইত্যাদির সূত্রে ও বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার। পকেটে প্রেসকার্ড রয়েছে, তা ছাড়পত্র। দুই কাঁধে ঝোলানো দামি ক্যামেরা দু’ তিনটি। স্টিল ফোটোগ্রাফার। স্বাধীন ফোটোগ্রাফার। রসিক মানুষ। চত্বরে ঢুকেই হন্তদন্ত ভাবে বসেই গম্ভীর মুখে পরিচালক যুবক অসীমকে উদ্দেশ্য করে সামনের দিকে চোখ পেতে জিগ্যেস করলে, “কত করে?”

নতর্কীদের ভিড়ের দিকেই চোখ রেখে ফের কিছু জিগ্যেস করার আগেই অসীম হেসে জবাব দিল, “কোনটি?”

Advertisement

বুঝলুম অশালীন রসিকতা। চুপ করে রস গ্রহণের চেষ্টা করছি।

পলের চট জবাব, “ওয়ান অফ দোজ! কোই ভি হো?”

অসীম হাসতে হাসতেই পদ পূরণ করলে যেন,

“তুম হি যাও। পুছ লো।—”

সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ বগলের একটি ক্যামেরা বাগিয়ে পল চলল ডান্সারদের দিকে।

বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্থাপিত বিদ্যালয়ের ছাত্র। একেবারে শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনও চিহ্ন নেই এমন কথা যেমন বলা যাবে না, ঠিক তেমনই, একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা বলে নিজেকে ভাবতে পারাও কঠিন। বঙ্গবাসী কলেজের সাধারণ ছাত্র হলে এবং মধ্য বয়সি যুবক হলে যেমন হওয়া উচিত, কলমচি তাই। সমাজ-সংস্কার টনটনে। অথচ ‘কুতুহল’ পুরো মাত্রায়।

তখন শুটিং থামিয়ে রিহার্সাল চলছে। মুভি ক্যামেরা বন্ধ। আমারও হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল পল। তিন সারিতে দশ জন করে মেয়ে-মহিলা। সাজ-পোশাক, যেটুকু না পরলে সেন্সর আটকাবে, সেটুকু তো পরতেই হয়। তাও সব ঝলমলে। চোখ ধাঁধানো কাচুলি টাইপ বক্ষঃবন্ধনী। নিম্নাঙ্গে হাফ প্যান্ট জাতীয় আবরণ। প্রায় মেয়েদের চামড়া কামড়ে রয়েছে।

শেষের দিকে তৃতীয় সারির কোণের দিকে তিন চার জন যারা মুদ্রা প্র্যাক্টিস করছে, তাদের দিকে ক্যামেরা বাগিয়ে, তাক করে ‘ক্লিক’ করলে পল। উক্ত তিন চার জন নর্তকী মুচকি হেসে ইশারায় জানালো ফটোর ‘কপি’ চাই। হাত উঠিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাদের আশ্বাস দিল পল সাহেব। পাবে, পাবে। তার পর আমায় দেখিয়ে মুখে হাতের আড়াল দিয়ে চাপা কণ্ঠে জানালো, ‘বাঙালি বাবুমশাই’। আমি তাড়াতাড়ি সরে এলুম ওখান থেকে। অসীম ও অন্য কলাকুশলীদের গণ্ডিতে। ফিরে এল পল সাহেব। হাসতে হাসতে বলল, ‘‘অমন পালিয়ে এলে কেন বাবুমশাই?”

“ধ্যাত্‌! ওই ভাবে কেউ আলাপ করায় নাকি!”

বিহারের মানুষ রতন পল। বিহারের আধা বাঙালি। মা বিহারি, বাবা বাঙালি। দেশছাড়া বহু দিন। সেই সত্তর দশকের যুবক পল মুলুক থেকে মুম্বই চলে এসেছে। স্কুল ফাইনাল পাশ। কলেজে পড়তে পড়তে বন্ধু-বান্ধবদের কথায়, “গ্যাস খা গিয়া। তু তো দিখনে মে একদম হিরো। ছ’ফিটের কাছাকাছি মজবুত শরীর। মিষ্টি হিরো হিরো বদন। গানভি আচ্ছা গাতা হ্যয়। কলেজে পড়ে করবি কী? কেরানি হবি, না স্কুল মাস্টার!! শুনতে শুনতে কান পচে গেল। গ্যাস খেয়ে চলে এলাম এখানে। সেই থেকে স্ট্রাগল করছি। দু’ একটা ছুট্টা রোল করেছি—ব্যস।”

“ক্যামেরা কাঁধে ঝোলালে কবে থেকে?”

“সে অউর এক গোল্পো।—বাবুরাম ইশারা—কয়েকটা বই করেছিল। একটা না দুটো চলেছিল, বাকি সব সো গয়া থা! তো, ওই ইশারা সাহাবের থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বছর দেড় দুই কাজ করেছিলাম। তখন, ক্যামেরাতে ফটো তোলার অভ্যাস হয়েছিল, কন্টিনিউটি রাখার জন্য। এক একটা শটের পর কে কোথায় আছে, কী ভাবে বসে দাঁড়িয়ে আছে, সেইগুলো নোট রাখার জন্য স্টিল ফটো তুলে রাখতে হত। যাতে পরের সপ্তাহে পরের শট তুলতে গেলে যেন গুলিয়ে না যায়। সেই কন্টিনিউটি রাখার স্ন্যাপ তুলে রাখতে হত আমাকে।”

শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেল ঠিক দশটায়। এর পরে, কাজ বন্ধ না করলে সকল কলাকুশলী, কর্মীদের ‘ওভারটাইম’ গুনতে হবে। শক্তি ফিল্মস অন্তত এ জাতীয় এক্সট্রা নতর্কীদের সমবেত নাচের জন্য অত ওভারটাইম গুনতে রাজি নয়। নৃত্য-পরিচালক সরোজ খানকে একটু তাড়া দিয়ে দশটাতেই প্যাক-আপ হয়ে গেল।

“এখন তো কোনও কাজ থাকতে নেই। রাত দশটায় চলো— গলা ভেজানো যাক।”

রতন পলের আহ্বানের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকে। মন টানে। ফলে, ওর সঙ্গে অটো-রিকশায় বসে চললুম। ‘মালবনী’তে ‘সংগীতা বার’-এ গিয়ে ঢুকলুম দু’জনে। গাইড পল সাহেব। ঢুকতেই একটা মিশ্র গন্ধ। সিগারেটের ধোঁয়া, অ্যালকোহল, সেন্ট-এর গন্ধ--- সব মিলিয়ে মিশিয়ে এ গন্ধের কোনও নাম নেই। বদ্ধ। লম্বা ফালি ‘ঘরে’ এসি চলছে। গরম কম। তবে, সব মিলিয়ে একটা গুমোট ভাব। দরজা দিয়ে ঢুকতেই জোড়া জোড়া টেবিল চেয়ারের মাঝখানে এক ফালি যাতায়াতের পথ। টেবিলের সারি ও উক্ত পথটি শেষ হয়েছে— একটি মঞ্চ টাইপের জায়গায়। সেখানে একটি মহিলা মাইক হাতে গান গাইছে—

“মুন্নি বদনাম হুয়ে, হাঁ, তেরে প্যার সে—”

মহিলা বা মেয়েটিকে বলা যায় “ক্রুনার”।

“এই রকম দু’ তিন জন ক্রুনার আছে এখানে। তাদের মধ্যে চুমকি একজন। এখানে ও ডান্সারদের লিস্টে ওর নাম যদিও চুমকি। আসল নাম সরলা।”

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুলিয়ে নাচতে নাচতে, গান গাইতে গাইতে আমাদের টেবিলে চলে এল। বাজনার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল আমাদের, “কী খাবেন? হুইস্কি না রাম?”

অর্ডার নিয়ে মহিলা চলে গেল। আমাদের দু’জনের গ্লাস আসতে আসতে, দেখা গেল সেই শুটিংয়ের শেষ সারির মেয়ে দু’টি। পেছনের দরজা দিয়ে হয়তো ধারের গ্রিনরুমে ঢুকে এরই মধ্যে পোশাক পাল্টে মেক-আপ ঠিক করে এসে দাঁড়াল মঞ্চে।

রতন পল বলল,

“ওই যে চুমকি বা সরলা, আমাদের রাঁচির মেয়ে। ‘হিনু’ এলাকায় থাকে।

সামান্য ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলুম, “তোমার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে নাকি?”

“ছিঃ! অমন বলতে নেই। ঠিক সময়ে বিয়ে হলে ওই সরলার মতো মেয়ে হত আমার।”

কথা ঘুরিয়ে মন্তব্য করলুম, “তোমায় পল, দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই—”!

সত্যিই। ওর শরীরের গড়ন-পেটন ভাল। বেশ ফর্সা রং। নাসা উন্নত। মেদের নামগন্ধ নেই। ঠিক ঠিক বয়স অবিশ্যি বোঝা যাবে না। ধীরে সুস্থে নাচা-গানা দেখতে দেখতে দু’তিন পাত্তর ও কাবাব, চিকেন টিকা খাওয়া হল। লাস্ট অর্ডার রাত বারোটায়। বার ডান্সাররা নিয়মমাফিক বারোটায় ‘নাচা-গানা’ বন্ধ করে ঘরোয়া পোশাকে বেরিয়ে আসে।

চুমকি ও অন্য নর্তকীটি, যার নাম জানলুম লালি। সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে এলো বারের বাইরে। টালমাটল দু’একজন করে বেরিয়ে আসছে। একজন চুমকির কাছে এসে দাঁড়িয়ে দু’বার টাল সামলে বলল, “চলতে হো?”

চুমকি কোনও কথা না বলে পলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। পল বললে, “নেহি ভাই। আগে বাড়ো।”

ওরা হেসে ফেললে, “খ্যাঃ খ্যাঃ! বুক কর লিয়া ভাই! ঠিক হ্য্যয়—” বলে টলায়মান মূর্তিদ্বয় হাঁটতে লাগল। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়। তিন চারটে খালি রিকশা, দু’টি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। আরও তিন চার জন নাচিয়ে গ্রিন রুম থেকে বেরিয়ে এসে, সামনে আলো-অন্ধকারে গুছিয়ে দাঁড়াল। রিকশা, ট্যাক্সিওয়ালারা যেমন খদ্দের ধরার আশায় দাঁড়িয়ে, এই তিনটি মেয়েও কি তাই? হবেও বা। পলকে বললুম, “আমি একটা রিকশা ধরে এগোই। চার জনকে তো আর ট্যাক্সি নেবে না।” অভয় দেবার মতো আমাকে হাত তুলে দেখিয়ে, একটা ট্যাক্সিকে ইশারা করল। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করলে, “কিধার জায়গা সাহাব?”

“হাওয়া খানে—” বলে, মিটারটা নিজের হাতে ডাউন করে পেছনের দরজা খুলে দিল। মেয়েরা উঠে পড়তেই, আমায় ইশারায় ঢুকতে বলে, বললে, “লালির পাশে বসে পড়ো—খাসা মেয়ে।”

এগিয়ে এসে ড্রাইভারের পাশে ঢুকে গেলুম। ওকে বললুম, “না, তুমি যাও। তোমার অ্যাতো দিনকার চেনাজানা।”

কথা বলতে বলতে গাড়ি ছুটল আন্ধেরির দিকে, দক্ষিণে।

“লালি আমার যখন-তখন মডেল। সরলা, মানে, এখানে চুমকি আমার দেশের মেয়ে।”

সামনে বসে শরীর সামান্য পিছনে ঘুরিয়ে হাতজোর করে নমস্কার করলুম। ওরাও। যোগেশ্বরীতে নেমে গেলুম। ওরা এগিয়ে গেল। লালি ও চুমকি থাকে আন্ধেরির পূর্বে, ‘মরোল নাকার’ কাছে, পেয়িংগেস্ট।.......

অসীমের সাক্ষাত্‌কার নেবার ছিল। নর্তকীর দলের শুটিং শেষ হবে কালকে। পল এল। ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কি কথা বলে, দূর থেকে দেখেই আমার কাছে এসে বলল, “কী খবর? দাদার তবিয়ত ফাস্ কেলাস্?”

“হ্যাঁ। তোমার?”

“টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। সন্ধেবেলা চলে এস। ‘সংগীতা’য়। আড্ডা হবে। বলে, যেমন ধূমকেতুর মতো এসেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল।

সাক্ষাত্‌কার শেষে আমাকে এডিটিং টেবিলে ছবির ‘রাসেস’ দেখাল অসীম। স্টুডিও থেকে বেরোতে বেরোতে রাত ৯টা। ‘সংগীতা’ বারে গেলুম। পল দুটো পেগ নিয়ে টেবিল দখল করে রয়েছে। তখনও নাচা-গানা আরম্ভ হয়নি। ঠিক দশটায় শুরু হল। লালি চুমকিও এসে মঞ্চ অধিকার করল। কথায় কথায় পলের মুখে জানলাম, চুমকির বাবা-মা পলের খুব চেনা। নেচে নেচে ‘হিরোইন’ বা ‘আইটেম গার্ল’ হবে আশায় চুমকি বাড়ি থেকে ছ’বছর আগে চলে এসেছে এখানে। নানান ঘাটের জল খেয়ে, কোরামের নর্তকী হয়ে অবরে-সবরে কাজ পায়। পাঁচশো, হাজার, খুব বেশি হলে দু’হাজার করে পায়। তাতেই দিনগুজরান। ‘সংগীতা’য় নেচে একটা সামান্য মাইনে পায়। বখশিসের আধা বখরা মালিকের সঙ্গে। এই করে চলছিল।

‘‘খুচরো খদ্দের হয়ে আলাপ করেছিলুম বছর খানেক আগে। ক্রমে, ক্রমে টের পাই, ও আমাদের ঝাড়খণ্ডের মেয়ে। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলুম।” পল গেলাস শেষ করে বলল, প্রথমে খুব ‘না না’ করেছিল। ‘পাড়ার লোক কী বলবে?’, ‘হেরো’ বলে ঠাট্টাও করবে। তা ছাড়া, বাব-মার বয়েস হয়েছে। ওঁরা মেয়ে ফিরে আসবে শুনে অলরেডি পাত্র সন্ধান শুরু করে দিয়েছেন। সরলা একলা যেতে ভয় পাচ্ছে। বাধো বাধো ঠেকছে। লেজুড় হয়ে যেতে হবে।

পর দিন ওদের নাচের শেষ দিন। দুটোয় শুটিং প্যাকআপ। ক্যাশ মজুরি নিয়ে সন্ধেবেলা ওরা ট্রেন ধরবে। পলের অনুরোধ ফেলতে পারলুম না। কুর্লায় ‘তিলক টার্মিনাসে’ গেলুম রাত এগারোটার পর। বারোয়াটায় ছাড়বে ‘হাতিয়া এক্সপ্রেস’। কাঁধের ফ্ল্যাক্সের জলে মোশানো সোমরস নিয়ে এসেছে পল। দু’বার ঢোক মারলুম দু’জনে। লালিও এসেছে সঙ্গিনীকে সি অফ করতে। চুমকিকে বললুম, “কেমন লাগছে? ”

“দাদা, কী রকম গা শিউরে উঠছে। ভয় ভয়। ‘হেরো’ মনে হচ্ছে নিজেকে। আবার বাবা-মায়ের ঝাপসা মুখ মনে পড়ছে। আনন্দ-ভয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”

ইঞ্জিন জুড়লো হয়তো। গোটা গাড়িটা নড়ে উঠল।

চুমকি আর লালি গলা জড়াজড়ি করে কী যেন বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল। পল বললে, “দু’ হপ্তা পর ফিরে আসব— সরলার বিয়ে খেয়ে— ওঠো, ছেড়ে দেবে—।”

সরলা হঠাত্‌ ঢিপ করে ঝুঁকে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে, বললে, “দাদা, আশীর্বাদ করুন। যেন ভাল থাকি। বাবা-মাকে”— বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল। শব্দ হারিয়ে গেল। লালির দু’চোখ লাল। কাঁদছে। আমার কেমন একটা অনুভূতি হল। লিখে বোঝানো যাবে না। সামান্য বেদনা হয়তো ছিল। মেয়েটা ভুল করে এসে, হেরে গেল। এবং আনন্দও হল, ‘মোহমুক্তি’। চোখ ঝাপসা হয়ে এল।

রাতের রেলগাড়ির শেষ কামরার লাল আলোটা দূরে সরে যাচ্ছে। তবু, ভেজা চোখেও, কী ভীষণ লাল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement