লালির বাড়িতে কেজরীবাল। পাশে মণীশ সিসৌদিয়া। ছবি: পিটিআই।
প্রচার শেষেও দিব্যি প্রচারে রয়ে গেলেন অরবিন্দ কেজরীবাল।
আগামিকাল ভোট দেবে রাজধানী। নির্বাচনী আইন মোতাবেক তাই গত সূর্যাস্তেই মাইকের হুঙ্কার আর শোভাযাত্রা থেমে গিয়েছে দিল্লির অলিগলিতে। একে চৈত্রের চড়া রোদ্দুর। তার ওপর তিন সপ্তাহের নাগাড়ে পরিশ্রমে নেতাদের কারও গলা ভেঙেছে, কেউ দু’পোঁচ বেশি কালো হয়েছেন। পরিবারকেও সময় দিতে পারেননি এত দিন। আজ তাই প্রার্থীরা অধিকাংশই ছিলেন বাড়িতে ছুটির মেজাজে। ভোটের অঙ্ক কেউ যে একেবারেই কষতে বসেননি এমন নয়, তবে ঘরবন্দি হয়ে এসি-র আরামে।
আর এই ফাঁকা মাঠেই আজ কার্যত একা দাপিয়ে বেড়ালেন আম আদমি পার্টির সর্বাধিনায়ক কেজরীবাল। গত কাল উত্তর-পশ্চিম দিল্লির সুলতানপুরি এলাকায় দলীয় প্রার্থী রাখি বিড়লার হয়ে প্রচারের সময় তাঁকে মালা পরিয়েই সপাটে থাপ্পড় মেরেছিলেন এক অটোচালক। সেই হামলাকারী, লালি প্রসাদের বাড়িতে আজ সকালে পৌঁছে যান কেজরীবাল। খবরের গন্ধে গন্ধে পৌঁছয় সংবাদমাধ্যমও। লালিকে জড়িয়ে ধরে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাগের কারণ জানতে চাইলে কেঁদে ফেলেন ওই অটোচালক। সেখান থেকে কেজরীবাল যান জামিয়ানগরে আর এক হামলাকারীর বাড়ি। দিন পাঁচেক আগে আব্দুল ওয়াহিদ নামে ওই ব্যক্তিও একটি শোভাযাত্রায় দু-দু’বার মারার চেষ্টা করেছিলেন কেজরীবালকে। ওয়াহিদের সঙ্গেও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন তিনি।
গোটা ঘটনায় কার্যত হতভম্ব বিজেপি-কংগ্রেস যতক্ষণে আদর্শ আচরণবিধি ইত্যাদির প্রশ্ন তুলে আপের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে, ততক্ষণে কেল্লা ফতে করে বেরিয়ে গিয়েছেন কেজরীবাল। আজ বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে দিল্লির তাবড় রাজনৈতিক নেতা যখন অনুপস্থিত, তখন সকাল থেকেই সরাসরি প্রচারে না নেমেও প্রচারমাধ্যম জুড়ে থেকেছেন একা তিনিই। নির্বাচনের ঠিক এক দিন আগে কেজরীবালের এই ‘ক্ষমাশীল’ আচরণ ভোটবাক্সে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই আশা করছেন আপ নেতৃত্ব।
অটোচালক লালি গত কাল কেজরীবালকে থাপ্পড় মারার পরেই আপ কর্মীরা তাঁকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। পুলিশ লালিকে আটকও করেছিল। কিন্তু আপ কোনও অভিযোগ না জানানোয় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজ পশ্চিম দিল্লির কিরারির বাড়িতে লালির সঙ্গে কেজরীবাল ও তাঁর দলীয় সহকর্মী মণীশ সিসৌদিয়ার ছবি দিনভর ঘুরেফিরে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। দেখা গিয়েছে, বিধ্বস্ত চেহারা, ফোলা চোখমুখ, ছেঁড়া জামা পরা লালি হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলছেন। পাশে চেয়ারে বসে কেজরীবাল। মাথায় নেই ‘ম্যায় হুঁ আম আদমি’ লেখা টুপি। গম্ভীর মুখে শুনছেন। কেজরীবালকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করলেন লালি।
গত কাল ক্ষিপ্ত হয়ে অভিযোগ করেছিলেন, অটোচালকদের সঙ্গে বেইমানি করছেন কেজরীবাল।
আজ নেতাকে সামনে পেয়ে কী বলেছেন লালি?
লালি বলেছেন, “আপনি আমার কাছে ভগবানের মতো। আমিও আপের সমর্থক। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমাকে ক্ষমা করুন।” পরে সংবাদমাধ্যম জানতে চায়, চড়টা কেন মেরেছিলেন? লালি বলেন, “বিধানসভা নির্বাচনে আপের হয়ে খেটেছিলাম। কিন্তু দল ইস্তফা দিয়ে দেয়। এতে আমার মনে হয়েছিল, সমর্থকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। কেজরীবালের জনতা দরবারেও গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা হয়নি। তাই রেগে ছিলাম। কাল কেজরীবালকে সামনে দেখে রাগ সামলাতে পারিনি। কিন্তু বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।”
গত কালের ওই ঘটনার পরেই শোভাযাত্রা থামিয়ে রাজঘাটে মহাত্মা গাঁধীর সমাধিস্থলে প্রার্থনায় বসেন কেজরীবাল। আগাম অনুমতি না নিয়ে পাঁচ জনের বেশি লোক নিয়ে প্রার্থনাস্থলে বসায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ইতিমধ্যেই তাঁকে নোটিস পাঠিয়েছে দিল্লি নির্বাচন কমিশন। আজকের ঘটনা নিয়েও নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে কংগ্রেস-বিজেপি। তাদের অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে অভিযুক্তদের বাড়ি গিয়ে ফের আচরণবিধি ভেঙেছেন কেজরীবাল।
যদিও বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, আজ কার্যত কমিশনের আচরণবিধি সংক্রান্ত আইনের ফাঁক গলেই সুকৌশলে জনসংযোগ সেরেছেন কেজরীবাল। আপের তরফেও বলা হচ্ছে কেজরীবাল দিল্লির প্রার্থী নন। তিনি কারও বাড়ি যেতেই পারেন। কমিশনের নিয়ম হল, ভোটের আগের দিন কোনও রাজনৈতিক দল তার প্রার্থীর হয়ে প্রচার করতে পারবে না। সেই সূত্র ধরেই আপের বক্তব্য, আজ কেজরীবাল এবং সিসৌদিয়া লালির সঙ্গে শুধু দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা দলীয় টুপি পরেননি বা পতাকা নিয়ে যাননি। দলের হয়ে কাউকে ভোটও দিতে বলেননি। কেজরীবালকে দেখে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ভিড় করেন। আপের দাবি, এঁরা কেউ তাদের সক্রিয় সমর্থক নয়। আর সংবাদমাধ্যম কেন সঙ্গে গিয়েছিল, সেটা সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যক্তিগত বিষয় বলে বিরোধীদের অভিযোগ এড়িয়ে গিয়েছেন আপ নেতৃত্ব।
আপ নেতা দিলীপ পাণ্ডের বক্তব্য, “(আচরণবিধি) ভাঙা হয়েছে কিনা, তা বুঝবে নির্বাচন কমিশন। আমরা কী জানি!” তবে রাজধানীর অলিন্দের অনেকেই মনে করছেন, ভোটের আগে যে ভাবে অন্য দলগুলোকে ড্রিবল করে গোল দিলেন রাজনীতিতে তুলনায় নতুন কেজরীবাল, সেটা নিঃসন্দেহে শিক্ষণীয়।