হিন্দুত্বের রাশ ধরুন, মোহন শরণে মোদী

নিজের সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্কট কাটাতে এ বার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের শরণাপন্ন হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভাগবতের কাছে মোদী অনুরোধ করেছেন, আর্থিক সংস্কার এবং দ্রুত কর্মসূচি রূপায়ণকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর সরকার যখন জনমনে প্রভাব ফেলতে চাইছে, তখন সঙ্ঘ পরিবার যেন দেশে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি না করে, যাতে সরকারের ভাল কাজ ঢাকা পড়ে যায়।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১৭
Share:

নিজের সরকারের ভাবমূর্তির সঙ্কট কাটাতে এ বার আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের শরণাপন্ন হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

ভাগবতের কাছে মোদী অনুরোধ করেছেন, আর্থিক সংস্কার এবং দ্রুত কর্মসূচি রূপায়ণকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর সরকার যখন জনমনে প্রভাব ফেলতে চাইছে, তখন সঙ্ঘ পরিবার যেন দেশে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি না করে, যাতে সরকারের ভাল কাজ ঢাকা পড়ে যায়।

আরএসএস প্রধান ভাগবত এখন মধ্যপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখানে আরএসএসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছে। আরএসএস সূত্র বলছে, গোলমাল পাকাচ্ছেন এমন কিছু ব্যক্তি, যাঁরা সরাসরি আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত নন। আরএসএসের নির্দেশেও তাঁরা এ সব কাজ করছেন না। এই কারণে মোহন ভাগবত সঙ্ঘের নানা স্তরের নেতাদের কাছে বার্তা দিয়েছেন তাঁরা যেন ‘হিন্দু মায়েদের চারটি সন্তান হওয়া উচিত’ গোছের বিতর্ক থেকে দূরে থাকেন। আরএসএসের এক নেতা বলেন, প্রবীণ তোগাড়িয়া আমাদের কেউ নন। সাক্ষী মহারাজও তাই। সুতরাং তাঁরা আরএসএসের নির্দেশে এই কাজ করছেন, এমনটা কিছুতেই বলা যায় না।

Advertisement

ইতিমধ্যেই সাক্ষী মহারাজকে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরিয়েছে বিজেপি। প্রবীণ তোগাড়িয়াকে সংযত করার জন্য বলা হয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে। সমস্যা হচ্ছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মাথা অশোক সিঙ্ঘলের সঙ্গে প্রবীণ তোগাড়িয়ার সম্পর্ক সাপে-নেউলে। ফলে মোদীর ব্যাপারে সিঙ্ঘল নমনীয় হলেও তোগাড়িয়া তাঁর কথা শুনতে নারাজ। শুক্রবারও তিনি বলেছেন, সরকার নিষিদ্ধ না-করা পর্যন্ত বিধর্মীদের হিন্দুত্বে ফেরানোর (ঘর ওয়াপসি) কর্মসূচি চলবে। গুজরাতে কাজ করে আসা তোগাড়িয়া বরাবর ঘোর মোদী-বিরোধী। মোদীকে প্যাঁচে ফেলতে তিনি এখনও সাক্ষী মহারাজের বিষয়টিকে নিয়ে তিক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই ঘটনায় বিরক্ত মোদী উল্টে শঙ্করাচার্যকে দিয়ে একটি বিবৃতি জারি করিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে ভারতের মতো জনবহুল দেশে চারটি সন্তানের কথা বলাটা একান্ত অনুচিত।

কংগ্রেস মুখপাত্র অজয় মাকেন অবশ্য বলেন, এ সব আসলে বিজেপির দু’মুখো রণকৌশল। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে অমিত শাহ এই মেরুকরণের রাজনীতিটাই করেছেন। এখন দিল্লির নির্বাচনের আগেও করা হচ্ছে। দিল্লিতে জাত-পাতের ভিত্তিতে ভোট না করিয়ে ভোটব্যাঙ্কের ধর্মীয় বিভাজন করতে চায় বিজেপি। এটাও তাদের পুরনো কৌশল। এ নিয়ে মোদীর উদ্বেগ আসলে মায়াকান্না।

কংগ্রেস এ কথা বললেও বস্তুত গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই মোদী বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। ধর্মান্তরণের প্রশ্নটি সংসদের অধিবেশনের সময় তীব্র করে তোলাটা ঠিক কৌশল ছিল কি না, তা নিয়ে ধন্দ আছে বিজেপি শিবিরে। কাশ্মীর নির্বাচনের আগে জম্মুতে হিন্দু ভোটকে সুসংহত করার জন্য পণ্ডিতদের ঘরে ফেরার ডাক দেওয়া বা সংবিধানের ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করার কথা প্রচার করে উচিত কাজ হয়েছে কি না, তা নিয়েও এখন দলে জোর বিতর্ক চলছে। অমিত শাহ বিষয়টি নিয়ে কাশ্মীরের নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা রাম মাধবের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, সংসদের আসন্ন অধিবেশনে বিমা এবং জমি অর্ডিন্যান্স পাশ করানোটা খুব জরুরি। এই সময়ে কট্টরবাদীরা আবার এ ধরনের কোনও বিষয় সংসদে উত্থাপন করলে নরেন্দ্র মোদীর খুশি হওয়ার কারণ নেই। সরকার যখন পথ চলা শুরু করে, তখন লখনউয়ে আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকে স্থির হয়েছিল, রামমন্দির থেকে ৩৭০ ধারা পর্যন্ত বিতর্কিত বিষয়গুলি আগামী পাঁচ বছর শিকেয় তুলে রাখা হবে। এই বোঝাপড়া ভেঙে নানা সুরে কথা বলাটা উচিত কাজ হচ্ছে না বলেই মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। আবার আরএসএস-ও জানিয়েছে, ভবিষ্যতে আর যাতে বোঝাপড়ার অভাব না হয়, সে জন্য খুব শীঘ্রই বিভিন্ন প্রান্তের নেতাদের নিয়ে তারা বৈঠকে বসবে।

অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানাতেও বার বার সঙ্ঘ-সরকার সংঘাত বেধেছিল। স্বদেশি জাগরণ মঞ্চও বিপাকে ফেলত সরকারকে। এমনকী বাজপেয়ী নিজের বাসভবন সাত নম্বর রেস কোর্স রোডেও সরসঙ্ঘচালক কে সুদর্শনকে ডেকে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রফা হয়নি। বাজপেয়ীর আমলে বিমা, টেলিকম ও ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ নিয়ে বিস্তর বিরোধিতা করেছিল আরএসএস। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হাকে প্রায় পাগল করে তুলেছিল সঙ্ঘ। লালকৃষ্ণ আডবাণীও এক বার আলোচনার মাধ্যমে এই বিবাদ মেটাতে চেষ্টা করেছিলেন।

এখন পরিস্থিতিটা একেবারেই আলাদা। বিজেপি একাই ২৮২টি আসন পাওয়ায় মোদীর হাতেই সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে শরিকদের চাপ নেই। তাঁরই সেনাপতি অমিত শাহ বিজেপির সভাপতি হওয়ায় দলের সঙ্গেও কোনও সংঘাত নেই মোদীর। তার পরেও মোদীর এই অতিনিয়ন্ত্রণ ও সর্বময় কর্তৃত্ব সঙ্ঘ পরিবারের অনেকে ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। আবার আরএসএসের মধ্যেও অনেক স্তর রয়েছে। সেখানেও সর্বময় কর্তৃত্ব কারও একার হাতে নেই। সুরেশ সোনির পাশাপাশি কৃষ্ণগোপালকেও তুলে আনা হচ্ছে। রামলালের জায়গায় রাম মাধব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এঁদের নিজেদের মধ্যেও অনেক চোরাস্রোত রয়েছে। এই অবস্থায় মোদী যখন আর্থিক সংস্কারে বেশি আগ্রহী, কাশ্মীরের সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে তৎপর, গোধরার কলঙ্ক মোচনে মরিয়া সেই সময় সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝেই অকস্মাৎ তর্জন-গর্জন মোদীর মোটেই ভাল লাগছে না।

হরিয়ানা বা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরএসএসের পছন্দকে মর্যাদা দিয়েছেন মোদী। পদ্ম-সম্মানেও আরএসএসের বহু সুপারিশ মানা হয়েছে। এর পর বাজেট তৈরির আগে কোনও উগ্র হিন্দুত্বের প্রশ্ন তুলে বাড়াবাড়ি করাটা মোটেই কাম্য নয় প্রধানমন্ত্রীর। দিল্লি নির্বাচনের পর নভেম্বরে বিহারে নির্বাচন। এ ছাড়া এ বছরে আর কোনও নির্বাচন নেই। তাই মোদীর সনির্বন্ধ অনুরোধ মোহন ভাগবতের কাছে ‘আমাকে এখন সংস্কারের কাজটি করতে দিন।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement