দিল্লিতে দলের দফতরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার। ছবি: পি টি আই।
দলের একাংশের আপত্তি সত্ত্বেও সাধারণ কর্মী-সমর্থক ও আম-জনতার চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে হয়েছিল তাঁকে। বিপুল ভোটে জিতে সরকারের উপরে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সেই জোরেই দলের রাশও নিজের হাতে নিতে সক্রিয় হলেন নরেন্দ্র মোদী। আজ দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে গিয়ে মোদী মনে করিয়ে দিলেন, দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাই তাঁর শক্তির উৎস। তাঁর এই মন্তব্য দলের শীর্ষনেতাদের প্রতি বার্তা বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিজেপি সূত্র বলছে, মোদী আজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল ও সরকার দু’টিই চালাবেন তিনি। ইউপিএ জমানার মতো ক্ষমতার দু’টো কেন্দ্র রেখে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা তৈরি হতে দেবেন না। বরং দলের সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের পাশে নিয়েই এ বার দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণের কাজ করতে চান তিনি। মোদী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “সরকার হোক বা দল, তিনিই যে শেষ কথা বলবেন তা আজ ফের এক বার বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন মোদী। বিজেপিতে যে কার্যত মোদী যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে এটা তারই ইঙ্গিত।”
মোদীকে ঘিরে এমন একটা আশঙ্কা গোড়া থেকেই ছিল সঙ্ঘের। সরকারে এসেই মোদী যে ভাবে শক্ত হাতে প্রশাসনের রাশ ধরেছেন, তাতে কর্তৃত্বের প্রশ্নে ইতিমধ্যেই কপালে ভাঁজ পড়েছে সঙ্ঘ পরিবারের। মোদীর এ দিনের বার্তা সেই ভাঁজ আরও বাড়িয়ে দেবে।
আজকের দিনটিকে দলের কর্মী-সমর্থকদের ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন মোদী। বাজপেয়ী জমানার এক সাধারণ দলীয় কর্মী থেকে দেশ চালানোর দায়িত্বে অভিজ্ঞতার এই পুঁজিকে মূলধন করেই আজ কর্মী-সমর্থকদের মন জয় করে নিলেন তিনি। দলীয় কার্যালয়ের মঞ্চকে ব্যবহার করে ফের মোদী বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনিই সব। প্রশাসনের শীর্ষে যেমন রয়েছেন, তেমনই দলের অভিমুখ কী হবে তা-ও ভবিষ্যতে পরোক্ষে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করবেন। আর এই কাজে তিনি পাশে পেতে চান দলীয় কর্মী-সমর্থকদের। কারণ, মোদী বিলক্ষণ জানেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার ব্যাপারে এই সাধারণ কর্মী-সমর্থকদেরই চাপের কাছেই মাথা নোয়াতে হয়েছিল বিজেপি, এমনকী সঙঘের নেতৃত্বকেও। তাই ভবিষ্যতেও দলের এই সাধারণ কর্মীদের সমর্থনকেই নিজের শক্তির ভিত হিসেবে দেখতে চান মোদী। জানিয়েছেন, দলকে জেতাতে কর্মীরা প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন। আগামী দিনে মানুষের স্বপ্ন পূরণেও তাঁদের পাশে চান। মোদীর কথায়, “দেশবাসী দলের উপর প্রত্যাশা রেখেছিল। এখন দলের কাজ হবে দেশের মানুষের প্রত্যাশাকে পূরণ করা।” মোদীর দাবি, দলের কর্মী-সমর্থকরা যে জয় এনে দিয়েছেন, তা দেশের একুশ শতকের ছবিটাই পাল্টে দেবে। দলের কর্মী-সমর্থকদের অবদানের উপর এই বিশেষ জোর থেকেই স্পষ্ট, আমলাদের সঙ্গে তো বটেই, দলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গেও সমান ভাবে যোগাযোগ রেখে চলতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী।
আর তাই কিছুটা নজিরবিহীন ভাবেই মোদীর উদ্যোগে বিজেপি দফতরের সব কর্মীকে তিন মাসের বেতন বোনাস হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনীতির কেউ কেউ এটাকে বিজেপির মতো দলেও কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রবেশ হিসেবেই দেখছেন। দলের মধ্যে মোদীর এই বাড়তি সক্রিয়তায় বাজপেয়ী জমানার ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। বাজপেয়ী সরকারের নানা সিদ্ধান্তের সঙ্গে তৎকালীন সঙ্ঘ নেতৃত্বের বিবাদ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সে সময়ে দলের সভাপতির পদটিই কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি শোধরাতে বিজেপির মন্ত্রীদের সপ্তাহে এক দিন দলীয় কার্যালয়ে আসার ফরমান জারি করতে হয় সঙ্ঘকে।
কিন্তু ভবিষ্যতে এই ধরনের ফরমান জারি করা সঙ্ঘের পক্ষে আদৌ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকলীন জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিয়ম করে দু’বেলা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দলীয় কার্যালয়ে যেতেন। প্রমোদ দাশগুপ্ত বা পরবর্তী সময়ে অনিল বিশ্বাসের আমলেও আলিমুদ্দিন ও রাইটার্সের টানাপড়েন দেখা দিলে প্রাধান্য পেত পার্টির মতামতই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোদী যে ভাবে প্রশাসনের পাশাপাশি দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছেন, তাতে নাগপুর কতটা সরকারকে প্রভাবিত করতে পারবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো বিষয়ে সঙ্ঘের প্রত্যাশা রয়েছে এই সরকারের কাছে। কিন্তু প্রথম সপ্তাহেই মোদীর যা মনোভাব, তাতে বিশেষ উৎসাহিত হতে পারছে না সঙ্ঘ। শিক্ষার গেরুয়াকরণের প্রশ্নেও মোদীর অবস্থান সঙ্ঘ থেকে অনেকটাই আলাদা বলে মনে করছেন দলের একাংশ।
মোদী জানেন প্রশাসন সুষ্ঠু ভাবে চালাতে হলে দলের রাশ নিজের হাতে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তাই নিজের ঘনিষ্ঠ অমিত শাহকেই তিনি দলের সভাপতি পদে চাইছেন। যদিও সঙ্ঘ চাইছিল, রাজনাথ যদি মন্ত্রী হন সে ক্ষেত্রে প্রাক্তন সভাপতি নিতিন গডকড়ীকে ওই পদে ফেরানো হোক। কেননা, রাজনাথের থেকেও গডকড়ী অনেক বেশি নাগপুরের আস্থাভাজন। কিন্তু রাজনাথ-গডকড়ী দু’জনই এখন মন্ত্রিসভায়। এই পরিস্থিতিতে নতুন বিজেপি সভাপতি হিসেবে নাম উঠে এসেছে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ জে পি নাড্ডা ও অমিত শাহের। কিন্তু অমিত সম্পর্কে তীব্র আপত্তি রয়েছে সঙ্ঘে। কারণ অমিত সভাপতি হওয়া মানে দল ও সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ঘোষিত ভাবে মোদীর হাতে চলে যাওয়া। আপাতত তা রুখতে বিকল্প নাম নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন সঙ্ঘ ও বিজেপি নেতৃত্ব।