এ যেন ‘মারবো এখানে, লাস পড়বে শ্মশানে’! গোবি-সাহারায় ধুলোর ঝড় পাকিয়ে যত ঘনিয়ে আসবে, বৃষ্টি তত ঝাঁপিয়ে নামবে চেরাপুঞ্জিতে! ভূবনেশ্বর আইআইটি-র প্রকৃতিবিজ্ঞানী বিনোজ বেলু ও তাঁর সহ-গবেষকরা কিন্তু ঠিক এই কথাটাই বলছেন। তাঁদের দাবি উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ার আকাশে ধুলোর আস্তরণ যত পুরু হবে, যত বেশি এলাকা জুড়ে তা ছড়িয়ে থাকবে, ভারতে বর্ষার বৃষ্টি ততই তীব্র হবে। ওয়াশিংটনের ‘প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’-র সঙ্গে যৌথ ভাবে করা বিনোজের ওই গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি সম্প্রতি ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আবহবিদদের কেউ কেউ বলছেন, বিনোজের গবেষণা যথাযথ হলে ভারতে বর্ষার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এত দিনের ধারণাটাই বদলে যাবে। তবে আবহবিদদের অনেকেই গবেষকদের এই দাবিতে ভরসা করতে রাজি নন। বিনোজ নিজে অবশ্য বলছেন, এটাই ভারতে বর্ষা কম-বেশি হওয়ার একমাত্র শর্ত নয়। তবে এটা ঠিক, উত্তর আফ্রিকার উপরে জমে থাকা পুরু ধুলোস্তর ভারতের বর্ষাকে প্রভাবিত করে।
আইআইটি ভূবনেশ্বরের স্কুল অব আর্থ, ওশান অ্যান্ড ক্লাইমেট সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক বিনোজ বেলু বলেন, “বহু দিন ধরেই আমরা লক্ষ্য করছিলাম, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ার উপরে ধুলোর স্তরের ঘনত্ব বাড়লে এ দেশের বর্ষায় বৃষ্টিপাত বাড়ে। কিন্তু ওই ধুলোস্তরের সঙ্গে ভারতে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার সরাসরি কোনও বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক রয়েছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। আমরা গবেষণা করে দু’টি বিষয়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি।”
‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে ওয়াশিংটনের প্রতিষ্ঠানটির বিভাগীয় প্রধান, ফিলিপ র্যাশ বলেছেন, “যে সব মরসুমে সাহারায় ধুলোর ঝড় কম হয়েছে, ভারতে বৃষ্টিও কম হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সংগ্রহ করা এই তথ্যই আমাদের এই গবেষণার দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
কী ভাবে ধুলোর ওই স্তর ভারতের বর্ষার গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করছে?
বিনোজের ব্যাখ্যা, বাতাসের স্তরে জমে থাকা ধূলিকণা সূর্যালোক শোষণ করে। ধুলোর স্তরের ঘনত্ব যত বেশি হবে, সেগুলির মধ্যে আবদ্ধ তাপও তত বাড়বে। এর ফলে গোটা এলাকা আরও উত্তপ্ত হবে। ওই উত্তপ্ত ধূলিকণার মধ্যে ধরে রাখা তাপ আরব সাগরের উপরে বায়ুপ্রবাহের গতিকে বাড়িয়ে দেয়। গরম হাওয়া আরব সাগরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময়ে তা সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প টেনে নেয়, যা মৌসুমি বায়ুকে শক্তিশালী করে।
ধূলিকণার উপাদান কী হবে, তার উপরেও সূর্যের তাপ শোষণের বিষয়টি নির্ভর করে বলে দাবি বিনোজের। তিনি বলেন, বাতাসে কালো কার্বন বেশি থাকলে সর্বাপেক্ষা তাপ শোষিত হয়। সমুদ্রের নুনও তাপ শোষনের ক্ষমতা রাখে। তবে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার আকাশে যে ধূলিকণার স্তর থাকে, তা প্রধানত বালুকণা। মে থেকে অগস্ট মাস পর্যন্ত ওই ধূলিকণার স্তর একাধিক দেশের আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। তাতে বাতাস আরও বেশি তেতে যায়, যা আরব সাগরের ওপর বায়ুপ্রবাহের গতি ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। বিনোজের দাবি, ভারতে বর্ষার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাসে তাঁদের এই গবেষণার মূল্য অপরিসীম।
তবে ভারতীয় আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের আবহবিদেরা বিনোজের ওই গবেষণা নিয়ে এই মুহূর্তে ‘সরকারি ভাবে’ কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। দিল্লির মৌসম ভবনের এক আবহবিজ্ঞানী বলেন, “পূর্ব আফ্রিকা থেকে ধূলিকণা এসে এ দেশের বর্ষার বৃষ্টি বাড়িয়ে দেবে, এই তথ্য ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তবে যে পত্রিকায় নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ওই গবেষণাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াও কঠিন।”
পুণের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটেরোলজি’-র আবহবিজ্ঞানী গুরফান বেগ ভারতীয় বর্ষার চরিত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। বিনোজের গবেষণাপত্রটি তিনি পড়েননি। তাঁর মন্তব্য, “আমরাও এখানে এই ধরনের গবেষণা করছি। তবে এখনও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলার সময় আসেনি।”
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “বাতাসের ধূলিকণার সঙ্গে বৃষ্টিপাতের যে একটা সম্পর্ক রয়েছে, তা তো অজানা নয়। কিন্তু ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্র্নালে যে তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে আমার কোনও ধারণা নেই। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য না করাই ভাল।”