সানন্দ-সংবাদ

রাস্তার দু’ধারে কারখানা, গরম পকেটও

আমদাবাদ-ভুজ রাজ্য সড়কের সরখেজ মোড়। গুজরাতি মশলা চায়ে সবে চুমুক দিয়েছি। হঠাৎ নজরে এল নোটিসটা, চা-নাস্তার ওই দোকানের দেওয়ালেই লটকানো। কাগজে একটা মোবাইলের ছবি আঁকা, তার ওপর ‘ক্রস’ চিহ্ন। পাশে গুজরাতিতে গোটা গোটা লেখা। আশপাশে দু’এক জন যাঁরা চা খাচ্ছিলেন, বাঙালি সাংবাদিকের অনুরোধে অনুবাদটা তাঁরাই করে দিলেন ‘তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করুন। জমিজমা নিয়ে কথা বলতে হলে অন্য কোথাও যান।’

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

সানন্দ শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

মাথা তুলছে সারি সারি বহুতল। আজকের সানন্দ।—নিজস্ব চিত্র।

আমদাবাদ-ভুজ রাজ্য সড়কের সরখেজ মোড়। গুজরাতি মশলা চায়ে সবে চুমুক দিয়েছি। হঠাৎ নজরে এল নোটিসটা, চা-নাস্তার ওই দোকানের দেওয়ালেই লটকানো। কাগজে একটা মোবাইলের ছবি আঁকা, তার ওপর ‘ক্রস’ চিহ্ন। পাশে গুজরাতিতে গোটা গোটা লেখা। আশপাশে দু’এক জন যাঁরা চা খাচ্ছিলেন, বাঙালি সাংবাদিকের অনুরোধে অনুবাদটা তাঁরাই করে দিলেন ‘তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করুন। জমিজমা নিয়ে কথা বলতে হলে অন্য কোথাও যান।’ আর হ্যাঁ, এখানে মোবাইল-আড্ডা নিষিদ্ধ।

Advertisement

ব্যাপারটা কী? জানতে চাইলাম দোকান মালিক নন্দুভাইয়ের কাছে। যারপরনাই ক্ষোভ উগরে বললেন, “কী বলব সাব, এক কাপ চা নিয়ে তিন ঘণ্টা চেয়ার দখল করে রাখে। মোবাইলে শুধু জমি নিয়ে দরাদরি। ন্যানো আসার পর যার সামান্য জমিও ছিল, সে এখন লাখপতি। সকাল থেকে জমি বেচতে বেরোচ্ছে সব। আর আমার ব্যবসা লাটে উঠছে।”

সেই প্রথম আঁচ পেলাম ‘ন্যানো-কেন্দ্রিক আর্থিক পরিবর্তনে’র। একদা এ নিয়েই উদয়াস্ত চর্চা হতো বঙ্গদেশে!

Advertisement

ও দিকে নন্দুভাই থামবার পাত্র নন। হাল আমলের পয়সাওয়ালাদের নিয়ে তাঁর বেজায় রাগ। “আরে আপনারা তো শুধু মোদী-কুর্তার কথায় শুনেছেন। ‘সানন্দ-শার্ট’ ভি নিকাল গ্যায়া।” কী সেটা? নন্দু জানান, “ভাইসাব, এখানে জামার বুকের প্রথম বোতামটা আর রাখা হয় না। কারণ, কেউ সেটা লাগায় না। তা হলে জমি বিক্রির টাকায় কেনা সোনার মোটা চেনটা যে দেখানো যাবে না!”

কথাটা শোনার পর যন্ত্রচালিতের মতো চা শেষ করে গাড়িতে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। সরখেজ থেকে সানন্দ শহর ১০ কিলোমিটার। ন্যানো কারখানা ঠিক সানন্দে নয়, সেখান থেকে আরও ১২ কিলোমিটার দূরে। আপাতত গন্তব্য শহর। সানন্দ বাসস্টপে অপেক্ষা করছিলেন সুরেশভাই যাদব। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা। সঙ্গে আনা হরেক পরিসংখ্যান সহযোগে গুছিয়ে বোঝালেন শহরে ন্যানো-আগমনের ভাল-মন্দ।

‘ভাল’ কী কী? যেমন ন্যানো কারখানা হওয়ার আগে সানন্দ শহরে ১০০ বর্গফুট বাণিজ্যিক প্লটের দাম ছিল ১ লক্ষ টাকা। এখন সেটা অন্তত ১২ লক্ষ। আগে দু’টি মাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা ছিল এখানে। এখন ২৬টি ব্যাঙ্ক শাখা খুলেছে। সাইকেল, উটের গাড়ির বদলে মোটরবাইক, চার-চাকার ছড়াছড়ি। আর মন্দ? নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দেদার মদ বিক্রি বেড়েছে। বাজার চড়া হয়েছে। অ-গুজরাতিদের ভিড় বাড়ায় স্থানীয় সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার অভিযোগও উঠছে। অপরাধ বাড়ছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কী দেখেছেন? চশমাটা খুলে একটু ভাবলেন সুরেশভাই। তার পর আবার পরে নিয়ে জানালেন, সরখেজ থেকে বিরামগাঁও (মাঝখানে সানন্দ) পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে গত সাত বছরে অজস্র কারখানা গড়ে উঠেছে। মানুষের হাতে প্রচুর পয়সা এসেছে। সুরেশভাইয়ের কথায়, “সানন্দ বাজারে সাধারণ মানুষের পকেটেও শুধু ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট দেখতে পাবেন। টাকার দাম এই চত্বরে পড়ে গিয়েছে।”

তৃতীয় ঝটকাটা খেলাম। হঠাৎ মনে হল, ন্যানো কারখানার দৌলতে সানন্দের দু’পাশে সরখেজ থেকে বিরামগাঁও পর্যন্ত যে কলকারখানা এসেছে, তা তো পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনির মাইতিপাড়ার মোড় থেকে পালশিট পর্যন্তও হতে পারত। যদি সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানা গুটিয়ে চলে না যেতে হতো টাটা মোটরসকে! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো একই গোত্রে পড়ে যায় মোটরগাড়ি শিল্প আর চারুকলা শিল্প! ফলে আজ সানন্দের বাজারে লোকের পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট বেরোয়, আর সিঙ্গুরের চাষিদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দু’টাকা কেজি দরে চাল বিলোয়।

তবে যেটা আশ্চর্য লাগছিলটাটার হাত ধরে আসা নানা সংস্থাকে জমি বেচে সানন্দের লোকের দু’পয়সা হয়েছে শুনলাম। কিন্তু শহরটায় চাকচিক্য তেমন নেই। সুরেশভাই এর একটা ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর মতে, এখানকার জমির অধিকাংশ মালিক ‘কোলি পটেল’ সম্প্রদায়। আদি জীবিকা মূলত চাষবাস আর পশুপালন। এখন ন্যানো কারখানা আসার পর এঁদের হাতেই লাখ লাখ টাকা। কিন্তু সেই টাকার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না বলেই নাকি শহরের হাল ফিরছে না।

তা হলে কোথায় গেল সেই টাকা? কেউ স্রেফ জমিয়েছেন, কেউ মহাফুর্তিতে গড়িয়েছেন সোনার চেন। কেউ আবার টাকা লাগিয়েছেন নিজস্ব কারখানায় বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। সানন্দ থেকে বেরিয়ে ন্যানো কারখানার পথ ধরতেই তার প্রমাণ মিলল।

রাস্তার ধারে দু’ধরনের নির্মাণ। হয় কারখানা, নয় বহুতল। জানা গেল, গুজরাত সরকার নিয়ম করেছে, জমি নিলে তার ৪০ শতাংশ এলাকায় নির্মাণকাজ করা যাবে। বাকি অংশে গাছ লাগাতে হবে বা নির্মাণ বাদে অন্য কিছু। ফলে দুই বহুতলের মধ্যে ফাঁক রয়েছে অনেকটাই। দু’টো কারখানার মধ্যেও ভালই দূরত্ব। চমৎকার দৃশ্য।

ইস্, যদি ন্যানো কারখানার ভেতরে যাওয়া যেত। “কোনও ভাবেই সম্ভব নয়” বললেন এক পরিচিত। সম্প্রতি টাটার এক কর্মী পরিবারের এক জনকে বিনা অনুমতিতে কারখানায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পত্রপাঠ ব্যবস্থা নেন কর্তৃপক্ষ। কী ভেবে প্রথমে চলে এলাম ফোর্ডের গাড়ি কারখানার দিকে। ন্যানো কারখানার কাছেই। ভারতে এটাই তাদের সবচেয়ে বড় কারখানা। চারপাশে একের পর এক অনুসারী শিল্প। নজরে এল ভারত ফোর্জের কারখানাও। সংস্থার কর্তা বাবা কল্যাণী বেশ কয়েক বার কলকাতায় গিয়েছিলেন সিঙ্গুর-পর্বে। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের মঞ্চেও ছিলেন। টাটার সঙ্গে সানন্দে এসেছে তাঁর কারখানাও। টাটা বা ফোর্ডকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা দু’একটি সংস্থার কর্তার সঙ্গে কথা হল। তাঁরা অবশ্য জানালেন, ইদানীং বাজার খারাপ বলে ন্যানো কারখানা সপ্তাহে দিন তিনেক চালু থাকছে। তবে তাতে বসে নেই টাটারা। অন্তত ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের মঞ্চ থেকে আরও নতুন বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি।

টাটাদের ছোট্ট গাড়ির ব্যক্তিগত ব্যবসায় মন্দা হয়তো চলছে, কিন্তু সব চেয়ে তাক লাগানো ব্যাপারটা হল, একটা ন্যানো কারখানা ঘিরে শিল্পের এমন চৌম্বকক্ষেত্র। টাটারা আসার পর সানন্দের একদা এই ধুধু প্রান্তর যেন আলাদিনের গল্পের মতো বদলে গিয়েছে কারখানার সারিতে। ন্যানোর অদূরে যেমন ফোর্ড, ফোর্ডের পাশে বড় ব্র্যান্ডের ওষুধ কারখানা। এমনকী বিস্কুট কারখানা পর্যন্ত!

কী বুঝছেন এখানকার পরিস্থিতি? গাড়ির যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা একটি সংস্থার কর্তা স্পষ্ট জানালেন, ছ’বছরের মধ্যেই ‘অটো হাব’ হিসেবে গড়ে উঠেছে সানন্দ। একটু দূরে মেহসানাতে সুজুকি-ও বিশাল কারখানা গড়ছে। কিছুটা ঠাট্টার ছলেই বললেন, “

কারখানাটা নীল-সাদা রঙে সাজানো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পছন্দের রং। সান্ত্বনা বলতে এইটুকুই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement