শ্রদ্ধাবনত। সংসদের সেন্ট্রাল হলে ঢোকার আগে সিঁড়ি ছুঁয়ে প্রণাম নরেন্দ্র মোদীর। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
বহু বিজয়ী, এমনকী পরাজিত সাংসদও এখন দিন গুনছেন। কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার আশায়!
অনেকেই দর্জিকে দিয়ে নতুন ডিজাইনার শেরওয়ানি তৈরির অগ্রিম বরাত দিয়ে রেখেছেন। সে সব প্রায় তৈরিও হয়ে গিয়েছে! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রতি দিন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে তাঁদের মতামতও শুনে যাচ্ছেন। কিন্তু নিজে স্পিকটি নট! এখনও পর্যন্ত কোনও সতীর্থকেই তিনি জানাননি, তাঁকে সত্যিই মন্ত্রী করা হবে কি না বা হলেও কোন দফতর দেওয়া হবে! ফলে বাঘা বাঘা বিজেপি নেতাদেরও উদ্বেগ-উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। মোদীর নিজের কথায়, “আমি সকলের সঙ্গে কথা বলছি। সকলের মতামত নিচ্ছি। তার পর তালিকা চূড়ান্ত করব।” সবার কথা শুনলেও মন্ত্রিসভা গঠনে কিছু চমক দেখানোর জন্য নিজের মস্তিষ্কের উপরেই বেশি আস্থাশীল মোদী।
১৯৯৮ সালে লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশিত হয় ১০ মার্চ। অটলবিহারী বাজপেয়ী শপথ নেন ১৯ মার্চ। এই ন’দিনের দেরিটা হয়েছিল মূলত সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঘাটতির জন্য। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সরকার গঠন নিয়ে বিস্তর টানাহ্যাঁচড়া চলে। রাষ্ট্রপতি সবুজ সঙ্কেত দিতেই এনডিএ-র জোট রাজনীতির নানা চাপ সত্ত্বেও বাজপেয়ী দু’দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠন করে ফেলেন। মনমোহন সিংহও দু’-এক দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভার তালিকা তৈরি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এ বার মোদী ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন। শপথগ্রহণের দিন ধার্য হয়েছে ফলপ্রকাশের দশ দিন পরে, ২৬ মে।
কিন্তু এ বার কেন এত দেরি হচ্ছে?
নিন্দুকেরা বলতে পারছেন না যে, মোদীর মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীণ কলহ চরমে উঠেছে। বলা যাচ্ছে না যে, সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে তো বটেই, আডবাণী-সুষমা এমনকী রাজনাথের সঙ্গেও মোদীর বিবাদ চলছে। বিজেপি সূত্র বলছে, বিপুল ভোটে জেতার পর এখন মোদীই শুরু, মোদীই শেষ! কারও ট্যাঁ-ফোঁ করার ক্ষমতা নেই। আডবাণী, সুষমা, রাজনাথ, জোশী সবাই এখন যেন ভক্তিরসে আপ্লুত!
তা হলে?
মোদী ঘনিষ্ঠ গুজরাতের এক নেতা বলেন, “এটাই মোদী-স্টাইল। গুজরাতেও সরকার গঠনের সময় এমনটাই করেন তিনি।” মোদী দিল্লির নেতাদের বলেছেন, সরকার গড়ার পর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর এখন পাঁচ বছর কেন, আমরা আরও অনেক দিন থাকব। তাই ভাবনাচিন্তা করেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে চাই। আডবাণীর কাছে গিয়ে মোদী জানতে চেয়েছেন, কাকে মন্ত্রী করা উচিত, কাকে নয়। আডবাণী মনে করেন, রাজ্যসভার সদস্য অরুণ জেটলি যতই যোগ্য হোন, অমৃতসরে হেরে যাওয়ার পরে তাঁকে মন্ত্রী করা অনুচিত। সঙ্ঘ পরিবারও চিরকালই হেরো নেতাদের মন্ত্রী করার বিপক্ষে। ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, মোদী এ সব কথা গম্ভীর হয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে শুনেছেন। কিন্তু কোনও মন্তব্য করেননি। আবার অরুণ জেটলিকে ডেকে মোদী বলেছেন, কাকে কাকে মন্ত্রী করা উচিত, তার একটি তালিকা আমায় দিন। অরুণ সেই রকম তালিকা তৈরি করে জমাও দিয়েছেন। অবশ্য নিজের নামটি সেই তালিকায় রাখেননি তিনি। কিন্তু জেটলির দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁকে মন্ত্রিসভায় রাখতে হবেই। এমনকী শেষ পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রকই হয়তো দেবেন নরেন্দ্র।
জেতার পর বারাণসীর জনসভায় যোগ দিতে মোদীর সঙ্গে একই বিমানে যাতায়াত করেছেন রাজনাথ সিংহ। অনেক আলোচনা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। রাজনাথ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চান। তাঁর ধারণা, তিনি হবেন মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি। উল্টে মোদী তাঁর কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দফতরকে আলাদা করে দেওয়া উচিত কি না। রাজীব গাঁধী এটা করে সেখানে অরুণ নেহরুকে বসিয়েছিলেন। রাজনাথ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিভাজনের পক্ষে নন। কিন্তু মোদী যে কী চান, তা জানা যায়নি। আর সুষমা স্বরাজ? খুবই চাপের মধ্যে আছেন বিজেপির এই প্রবীণ নেত্রী। তিনি চাইছেন বিগ ফোর মানে স্বরাষ্ট্র, বিদেশ, প্রতিরক্ষা বা অর্থের মধ্যে কোনও একটি মন্ত্রক। কিন্তু জানেন না, ভাগ্যে কী জুটবে!
মন্ত্রিসভায় যাঁকেই আনুন, মোদী চাইছেন, তাঁর সরকারের আমলে বিভিন্ন মন্ত্রকের দুর্নীতি এবং দিল্লির কুখ্যাত দালাল ও ফোড়েতন্ত্রের অবসান হোক। মোদীর ঘনিষ্ঠদের দাবি, গুজরাতে কোনও মন্ত্রী কোনও ব্যবসায়ীর থেকে কোনও সুযোগ-সুবিধে নিতে পারেন না। মোদীই সেখানে সব কিছু ছিলেন। ব্যবসায়ীরা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে কথা বলে ব্যবসা করেন। বহু ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীকে ধরারও প্রয়োজন হয় না। এখন দিল্লিতেও সেই ব্যবস্থা চালু করতে চাইছেন মোদী। যদি কারও মন্ত্রকের দুর্নীতির কথা জানা যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে চান মোদী। অনেককেই তিনি বলে দিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তাঁকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে না। মোদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ইয়েদুরাপ্পা বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে এখন অনেকগুলি মামলাই মিটে গিয়েছে। দু’একটি অভিযোগ রয়েছে।” সঙ্গে সঙ্গেই মোদী তাঁকে বলেছেন, “তাড়াহুড়ো করছেন কেন? দুর্নীতির অভিযোগ মিটিয়ে যোগ দিন মন্ত্রিসভায়। জায়গা থাকবে আপনার জন্য।” এ কথা শুনে ভগ্ন মনে কর্নাটকে ফিরেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। রামবিলাস পাসোয়ানের বিরুদ্ধে সিবিআই প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছিল। টেনশনে রয়েছেন তিনিও। মোদীর বক্তব্য, শিবু সোরেন বা লালুপ্রসাদের নামে চার্জশিট থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মন্ত্রী করা হয়েছিল বলে আমরা মনমোহনের কম সমালোচনা করেছি? তা হলে নিজেরা কী করব? মোদীর এই কঠোর মনোভাবের জন্য অনেকেই মন্ত্রিসভা থেকে দূরে থাকতে চান।
রয়েছে আরও কিছু বিষয়। মোদীর নিজের বয়স এখন ৬৪। তাই তাঁর মন্ত্রিসভায় নবীনদের দাপটই বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। তা ছাড়া রাজ্যসভার সাংসদদের দিয়েও মন্ত্রিসভা ভরাতে রাজি নন তিনি। রবিশঙ্কর প্রসাদ, অরুণ জেটলি, সি পি ঠাকুরের মতো অনেকেই রাজ্যসভার সদস্য। তবে জাতপাত ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব তো রাখতেই হবে। বিহারে ভোট আসছে। দু’বছর পরে পশ্চিমবঙ্গেও ভোট। এই সব এলাকা থেকে মন্ত্রী তো করতেই হবে। যদিও কেউই জানেন না, আদতে কী হতে চলেছে!
সংবিধান অনুসারে মন্ত্রিসভা গঠন প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব এক্তিয়ার। কর্তৃত্ব দুর্বল হলে অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীকে এর-ওর মতামত নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হয়। এক বার প্রমোদ মহাজন এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমরা যতই সনিয়া গাঁধীর সমালোচনা করি, কংগ্রেসে তিনিই একক নেত্রী। তাঁর একার পক্ষে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বিজেপির সমস্যা হল, আমাদের দলে চার-পাঁচ জন শীর্ষ নেতা মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে কি নয়া হাওয়া এ বার বিজেপিতেও?