রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রচারক থেকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি। নরেন্দ্র মোদীর এই সফরকে সফল করে তুলতে ভোটের সময় হাজার-হাজার নতুন মুখ যোগ দিয়েছে সঙ্ঘ ও তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বিভিন্ন সংগঠনে। সরাসরি মোদীকে ভোট দেওয়ার ডাক না দিয়েও এঁরা ভোট-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পরিবর্তনের ডাক দিয়ে। অভিযান সফল তাঁদেরও। মোদী ও বিপুল সংখ্যক নব্য সদস্যের সেই সাফল্যকেই সামনে রেখে সঙ্ঘ এ বারে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর নয়া অভিযানে।
সঙ্ঘ বরাবরই বলে এসেছে, রাজনীতি করা তাদের কাজ নয়। কিন্তু সঙ্ঘ নেতারাই এখন কবুল করছেন, এ বারের লোকসভা ভোটে তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছেন। কাকে ভোট দেবেন, সে কথা সরাসরি বলেননি বলেই তাঁদের দাবি। তবে মনমোহন সিংহ জমানার দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি ও নিরাপত্তাহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন বিলক্ষণ। পৌঁছে গিয়েছেন গ্রামে-গ্রামে, ঘরে-ঘরে। জনজাগরণ অভিযান করেছেন দেশের কোণে-কোণে। আর বলেছেন সবাইকে ভোট দেওয়ার কথা। স্বয়ং সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত আবেদন করেছিলেন, ১০০ শতাংশ ভোট সুনিশ্চিত করার।
সঙ্ঘের নেতা রাম মাধব বলেন, “১৯৭৭-এ কংগ্রেস গণতন্ত্রের উপরে আঘাত করলে, তখনও জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছিল সঙ্ঘ। তাদের ১০ হাজার কর্মী গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কংগ্রেসকে উৎখাত করাই ছিল সে বারের লক্ষ্য। এ বারের ভোটেও একই ভাবে সক্রিয় হয়েছে সঙ্ঘ।” কিন্তু এ বার একটা নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। সঙ্ঘের প্রচারক বিপুল জনাদেশ নিয়ে দেশ শাসনের ভার নিতে চলেছেন সোমবার। এই অবস্থায় মোদী-হাওয়ায় ভর করে নিজেদের শক্তিও আরও বাড়িয়ে নিতে চাইছে আরএসএস। ভোটের সময় আরএসএসের রোজকার সকালের কর্মসূচি ‘শাখা’ বন্ধ রাখা হয়েছিল। যাতে কর্মীরা মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজে সময় দিতে পারেন। ভোট শেষ হতেই ফের শুরু হয়েছে শাখা। শুরু হয়েছে সদস্য সংগ্রহ অভিযানও। যে সব জায়গায় বিধানসভা নির্বাচন আসছে, সেখানেও সংগঠনের শক্তি বাড়াতেও আরও সক্রিয় হচ্ছে। ভাগবত কয়েক দিন আগে কলকাতায় গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, সেটিও তার অঙ্গ।
ভাগবত সরসঙ্ঘচালক হওয়ার পর থেকেই অবশ্য নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছিলেন। সঙ্ঘের পোর্টালেই ত্রিশ হাজার নতুন সদস্য যোগ দিয়েছেন। মোদী-হাওয়া শুরু হতেই এই সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে শুরু করেছে। ২০১২ সালে মাসে গড়পরতায় এক হাজার জনের মতো সদস্য হতেন অনলাইনে। এখন সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। বিশেষ করে যুবকদের আকৃষ্ট করার জন্য আরএসএসও এখন নিয়ম কিছুটা শিথিল করেছে। যুবকদের হাতে সময় কম থাকার কারণে রোজ শাখায় আসা আর বাধ্যতামূলক নয় এখন। গোটা দেশে এখন ৪৫ হাজার শাখা সক্রিয়। কিন্তু যাঁরা নিয়মিত শাখায় যেতে পারেন না, তাঁদের জন্য রয়েছে, ‘সাপ্তাহিক মিলন’ কর্মসূচি। এর সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। এ ছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহে ২৫০টি বিশেষ শাখাও চালু করেছে সঙ্ঘ।
সঙ্ঘের এক নেতা জানান, এ ছাড়াও রয়েছে আরএসএস-স্বীকৃত প্রায় ৪০টি সংগঠন। তার অন্যতম বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। অরুণ জেটলির মতো নেতা যেখান থেকে উঠে এসেছেন, সেই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২০ লক্ষ। প্রায় সমসংখ্যক সদস্য ভারতীয় কৃষক সঙ্ঘের। সারা দেশে বিদ্যা ভারতী নামে প্রায় ২৫ হাজার বিদ্যালয় চালায় আরএসএস। উত্তর-পূর্ব-সহ দেশের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের মাধ্যমে চলে ২৮ হাজার বিদ্যালয়। ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘও আরএসএসের শ্রমিক সংগঠন। এদের সদস্য ১ কোটি। তা ছাড়া শুধু আরএসএসেরই রয়েছে ৫০ লক্ষ স্বয়ংসেবক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আড়াই হাজার পূর্ণ সময়ের (ফুল টাইমার) স্বয়ংসেবক। এক সময় মোদী যা ছিলেন।
সঙ্ঘ নেতৃত্ব জানেন, মোদী হাওয়ায় সঙ্ঘের বিস্তার বাড়ার আশা এখন উজ্জ্বল। কিন্তু সঙ্ঘের শক্তিবৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভর করবে মোদী সরকারের কর্মক্ষমতার উপর। মোদীর উপরে পাহাড়-প্রমাণ প্রত্যাশার চাপ রয়েছে। আরএসএস সাধারণ সম্পাদক ভাইয়াজি জোশীর বক্তব্যেও সেই প্রত্যাশাটা স্পষ্ট। তাঁর কথায়, “মূল্যবদ্ধি, দুর্নীতি, নিরাপত্তার অভাব নিয়ে ইউপিএ সরকারের অনেক দুর্বলতা ছিল। নরেন্দ্র মোদী এই অবস্থার পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাই মানুষ মোদীর উপরে আস্থা রেখেছে। মোদী গুজরাতে কাজ করে দেখিয়েছেন। এ বারে কেন্দ্রীয় সরকারে বসেও তা করে দেখাবেন বলে আমাদের আশা। দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নতুন সরকারকে কাজ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের নিরাপত্তা নিয়ে যে কোনও রকম আপস করা হবে না, তা নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। পরিস্থিতি যা-ই হোক ন্যায়ের জন্য সরকার কাজ করবে, সেটি যেন সকলে দেখতে পান।”