কেরলে বাম জোট ছেড়ে বেরিয়ে কংগ্রেসের হাত ধরে এই দুর্মূল্যের বাজারে জুটেছে একটি আসন। আর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের শরিক হিসাবেই লড়াই করে হাত শূন্য! এমন জটিল পরিস্থিতিতে বামফ্রন্টের রাজনীতিতে তাদের ভবিষ্যৎ অবস্থান কী হবে, ঠিক করার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনারি অধিবেশন ডাকতে চলেছে আরএসপি। সেই বিশেষ অধিবেশনের দিনক্ষণ অবশ্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল রাজ্য কমিটির কাছ থেকে সবিস্তার রিপোর্ট নিয়ে জুলাইয়ে বৈঠকে বসবেন আরএসপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেখানেই প্লেনামের স্থান-কাল ঠিক হবে।
বাম জোট এলডিএফ ছেড়ে বেরিয়ে কেরলের আরএসপি যে ভাবে কোল্লম লোকসভা আসনটি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে লড়েছে, তাতে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ বাংলার আরএসপি নেতারা। সামগ্রিক ভাবেই এর ফলে বাম রাজনীতি সম্পর্কে ভুল বার্তা গিয়েছে এবং সিপিএমের কাছে আরএসপি-কে জবাবদিহিও করতে হয়েছে। এই মনোভাব নিয়েই দিল্লিতে গত দু’দিন দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে গিয়েছিলেন ক্ষিতি গোস্বামী, মনোজ ভট্টাচার্যেরা। কিন্তু কেরলে সিপিএমের তরফে পিনারাই বিজয়নদের যে আচরণের বিবরণ তাঁরা বৈঠকে বসে এন কে প্রেমচন্দ্রনদের মুখে শুনেছেন, তাতে কেরলের দলীয় নেতাদের যুক্তি একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না ক্ষিতিবাবুরা।
তা ছাড়া, বাংলা থেকে এক জনও সাংসদ না পেয়ে দিল্লিতে দলের কেন্দ্রীয় দফতরই যখন উঠে যাওয়ার জোগাড়, সেই সময়ে ‘বিক্ষুব্ধ’ হলেও সাংসদ প্রেমচন্দ্রন তাঁদের কাজে আসতে পারেন। সব দিক বিবেচনা করেই আপাতত প্লেনাম পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরএসপি।
কোল্লম আসনটি এ বার এলডিএফের কাছে দাবি করেছিল কেরলের আরএসপি। কিন্তু সিপিএম সেখানে দলের পলিটব্যুরো সদস্য এম এ বেবিকে প্রার্থী করার ঘোষণা করে দিয়েছিল। কেরলের আরএসপি নেতারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জানিয়েছেন, ওই ঘোষণায় আহত হয়ে তাঁরা ওই রাজ্যে অন্য কোনও বিকল্প আসনের জন্যও আলোচনা করতে রাজি ছিলেন।
কিন্তু বিজয়নদের আচরণ ছিল আগোগোড়াই রূঢ়। তাই কর্মী-সমর্থকদের ভাবাবেগ চিন্তা করেই তাঁরা বাম জোট থেকে বেরিয়ে আলাদা লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত কোল্লমে কংগ্রেস-সমর্থিত আরএসপি প্রার্থী প্রেমচন্দ্রন সিপিএমের বেবিকে হারিয়েছেন ৩৭ হাজার ভোটে।
কোন পরিস্থিতিতে বাম জোট ছেড়ে বেরোতে হয়েছিল, সেই ব্যাপারে প্রেমচন্দ্রনদের যুক্তি বুঝতে পারলেও কংগ্রেসের সমর্থন নেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এখনও একমত হতে পারেননি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। ক্ষিতিবাবুর কথায়, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটিকে ঠিক ভাবে না জানানোর জন্য কেরলের নেতারা ভুল স্বীকার করছেন। তবে আলাদা লড়ে ওঁরা স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন পেয়েছেন। কংগ্রেসের সমর্থন নেওয়ায় বিষয়টি এ বার লিখিত রিপোর্টে ওঁরা ব্যাখ্যা করবেন।” জুলাইয়ে তিরুঅনন্তপুরমে সেই রিপোর্ট নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ফের বৈঠক বসবে।
গোলমালের পরেই কেরলে দলের পর্যবেক্ষক হিসাবে পাঠানো হয়েছিল আরএসপি-র কেন্দ্রীয় নেতা অবনী রায়কে। তিনি একটি প্রাথমিক রিপোর্ট তখন দলকে দিয়েছিলেন। অবনীবাবুর বক্তব্য, “কিন্তু কেরলের পার্টি এখনও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেয়নি। ওই সিদ্ধান্তের সময় রাজ্য কমিটির কেউ ভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন কি না, সবই তাদের জানাতে বলা হয়েছে।” কেরল সিপিএমের অবশ্য অভিযোগ, আসন নিয়ে বিবাদের আগেই আরএসপি-র মাথায় অন্য পরিকল্পনা ছিল। যা মানতে নারাজ আরএসপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
কেরলের এই পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলার ছবি ক্ষিতিবাবুদের জন্য জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ রাজ্যে বাম শরিক হিসাবে চারটি আসনে লড়ে একটিও জিততে পারেনি আরএসপি। উল্টে ভোটের পরে শাসক দলের আক্রমণ থেকে বাঁচতে জেলায় জেলায় দলের কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপি-তে যেতে শুরু করেছেন। অবস্থা বিচার করে সিপিএমের সঙ্গে আর বামফ্রন্টে থাকার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন রাজ্য কমিটির কেউ কেউ। প্লেনামে আলোচনা করে এই সামগ্রিক পরিস্থিতির নিরিখেই নিজেদের অবস্থান যাচাই করতে চায় আরএসপি। দলের সাধারণ সম্পাদক টি জে চন্দ্রচূড়নের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়েই অবস্থান পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা হবে।