প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে নির্দেশ দিয়েছেন আগামী ৭ জানুয়ারি কলকাতার বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে হাজির থাকার জন্য। শুধু তাই নয়, ৬ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া নৈশভোজেও সামিল হবেন জেটলি। একই ভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীকেও বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে হাজির থাকার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে হাজির থাকার জন্য মমতা অনেক দিন আগেই আমন্ত্রণ জানান জেটলিকে। তিনি তখন তা গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যসভায় তৃণমূলের তাণ্ডবে একাধিক সংস্কারের বিল আটকে যাওয়ার পরে জেটলি ওই সম্মেলনে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তখনই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ওই সম্মেলনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
অথচ গুজরাতে ৮ জানুয়ারি প্রবাসী ভারতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও যাচ্ছেন না মমতা। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের দু’দিনের এই সম্মেলনে তাঁর কোনও প্রতিনিধি হাজির থাকতে পারেন বলেই খবর। ১০ জানুয়ারি ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ উপস্থিত থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন পটেল। তিনি সেটিতেও হাজির থাকছেন না।
মমতা বয়কটের রাজনীতি করলেও মোদী কেন জেটলিকে কলকাতা পাঠাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যাচ্ছে, মোদী পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে দেখাতে চান যে, তাঁর সরকার রাজ্যে মমতার সরকারের সঙ্গে বয়কটের রাজনীতি করতে চায় না। বিজেপি বনাম তৃণমূল এই রাজনীতির সঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্কের বিষয়টিকে তিনি মেলাতে চান না। ঘনিষ্ঠ মহলে মোদী বলেছেন, জয়ললিতা জেলে যাওয়ার পরেও তামিলনাড়ু সরকার তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। জয়ললিতা কখনও বলেননি, মোদী সরকারের ষড়যন্ত্রে তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। মোদীর বার্তা স্পষ্ট, আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি তদন্তের সঙ্গে উন্নয়ন নির্ভর রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।
মোদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে জেটলি কলকাতা গিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান, রাজ্যের উন্নয়নের পক্ষেই রয়েছে কেন্দ্র। রাজ্য বয়কটের রাজনীতি করলেও কেন্দ্র তেমনটা চায় না। তবে জেটলির কথায়, “রাজ্যের উন্নয়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেই কিন্তু এগিয়ে আসতে হবে।” জেটলি বারবারই বলেছেন, জমি অধিগ্রহণ বিলের বিরোধিতা করলে শিল্প হওয়া কঠিন। একই ভাবে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ আজ মুম্বইয়ে বলেছেন, তৃণমূল কয়লা বিল সমর্থন করলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরই লাভ হতো। তা না করে তারা জনবিরোধী এবং উন্নয়নবিরোধী কাজ করেছে। উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি সংস্কার প্রশ্নে তৃণমূলের সমর্থন পেতে মমতার দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথাও বলবেন জেটলি-গডকড়ীরা।
প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক মমতার সরকারের সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছেন মোদী। ক’দিন আগেই রাষ্ট্রপতি ভবনের নৈশভোজে মমতাকে দেখে কুশল বিনিময়ও করেছেন তিনি। উন্নয়নের প্রশ্নে িতনি যে ভেদাভেদ চান না, তা বোঝাতে ইতিমধ্যেই মানিক সরকারের মতো অবিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন মোদী। তা নিয়ে মানিককেই নিশানা করেছিলেন মমতা। এবং তিনি নিজে এখনও পর্যন্ত মোদীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি। তবে প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে এমন কথাও জানানো হচ্ছে, মমতা সাক্ষাৎ করতে চাইলে মোদী তৎক্ষণাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন।
তবে এ সব করতে গিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান যে বদল করা হবে না, তা-ও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। লোকসভা ভোটের পরের ছয়-সাত মাসে বিজেপি যে ভাবে তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে, সে জন্য সম্প্রতি অমিত শাহের পাশাপাশি মোদী-জেটলিরাও দলীয় বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এবং রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অমিত বলেন, “১৫ জানুয়ারি থেকে বিহার, বাংলা ও অসম সফরে যাব। লাগাতার এক মাসের জন্য। বর্ধমানেও সমাবেশ হবে।” বিজেপি সূত্র বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আরও আক্রমণাত্মক হবে। এপ্রিল মাসে কলকাতা পুর নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে বিজেপি ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা আরএসএসের সঙ্গে হাত মিলিয়েই এগোচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতেরও পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার কথা।
জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসবি চহ্বাণ সল্টলেকে তাঁর বাসভবনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন মমতা এ নিয়ে সরব হয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, সিপিএমের মতো অগণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানের সঙ্গে কেন চহ্বাণ দেখা করতে যাচ্ছেন? সে দিন নরসিংহ রাও রাজ্য নেতৃত্বকে বুঝিয়েছিলেন ‘কংগ্রেস দল হিসেবে সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ হতে পারে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক রক্ষা করার দায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার এবং আমার সরকারের।’ নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার সময় মমতার অভিযোগ ছিল, তারা সিপিএম সম্পর্কে নরম মনোভাব নিচ্ছে। তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। পরে এনডিএ জমানায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখায় বাজপেয়ী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মমতা। এখন মমতার বিরুদ্ধে মোদী-অমিত শাহ জুটির কৌশল হল, এক দিকে সংবিধান অন্য দিকে রাজনীতি। তবে একে দু’মুখো রণকৌশল বলতে রাজি নন মোদী। তাঁর কথায়, “এটি দু’মুখো রাজনীতি নয়। উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনীতি নেই। পশ্চিমবাংলার বাসিন্দারা কোনও দলের নন।”
সিবিআই নিয়ে যে অভিযোগ মমতা সরকার করছে, সে সম্পর্কে মোদী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার মন্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী সিবিআইকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইলে প্রথমেই রেহাই পেয়ে যেতেন কর্নাটকের দুঁদে বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পা। কিন্তু তাঁর তদন্ত লঘু হয়নি। নবীন পট্টনায়কের সচিবের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত করলেও ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তা ব্যক্তিগত ভাবে নেননি। মোদীর বিরুদ্ধে কোনও বিবৃতিও দেননি। এমনকী তরুণ গগৈ-ও তাঁর অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে কোনও বাধা দেননি।” সারদা-কাণ্ডে সিবিআই এবং ইডির তদন্তের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তথা দলের কোনও সম্পর্ক নেই বলে সাফ জানিয়েছেন অমিত শাহ। তাঁর বক্তব্য, “সিবিআই তদন্ত থেকে যা বেরোচ্ছে, তার ভিত্তিতে রাজ্যের মানুষ যা মনে করছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাজনৈতিক ভাবে শাসক-বিরোধী প্রচার করাটাই তো বিরোধী দলের কাজ। গত তিন বছরে খুব দ্রুত রাজ্যের মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস মৃত। সিপিএম অদৃশ্য। বিজেপি প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় রণেভঙ্গ দেওয়াটা রাজ্যের মানুষের স্বার্থবিরোধী কাজ হবে।”
তাই কলকাতায় গিয়ে অরুণ জেটলি রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবেন। নিতিন গডকড়ী সড়ক নির্মাণের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থসাহায্যের কথা ঘোষণা করবেন।
আর সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলবেন, ভাগ মমতা ভাগ!