এই সেই মুসাফিরখানা। ছবি: অগ্নি রায়
সে এখানকার ভূমিপুত্র! এক টানে তার লম্বা সিগারেট শেষ করার গল্প এখানে উপকথা। কাঁচা মাংস, সুর্মা আর আতরের পাঁচমেশালি গন্ধে ভরপুর পাখমোড়িয়া স্ট্রিটের এই খন্ডহর-সম বাড়ির মধ্যে তার ঘরটি চব্বিশ ঘণ্টাই তালা দেওয়া। যার চাবি গোয়েন্দাবাহিনীর কাছে।
ইট বের করা দেওয়াল আর ভাঙা ঝুলবারান্দাওয়ালা বাড়িটির নাম মুসাফিরখানা। যার একটি আধো অন্ধকার ঘরে থাকত সপরিবার দাউদ ইব্রাহিম। মুম্বই বিস্ফোরণের পর ২১ বছর কেটে যাওয়া সত্ত্বেও তার টিকির দেখা পায়নি নয়াদিল্লি। প্রত্যেক বারের মতো এ বারেও লোকসভা নির্বাচনে তাকে ঘিরে চাপানউতোর শুরু হয়েছে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে।
মুম্বই ভিটি-র বড় রাস্তা ছেড়ে কুখ্যাত ভিন্ডিবাজারের পেটের অলিগলি ঘুরে ২৫ নম্বর পাখমোড়িয়া স্ট্রিটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানেই তো বড় হয়ে উঠেছিল দাউদ। রত্নগিরির খেড়ে জন্মানোর কিছু পরেই এ পাড়ায় চলে আসে দাউদ। অদূরেই মসজিদ। নেড়ি কুকুর, নোংরা গলি, আলোহীন মহল্লা। যে ভিন্ডিবাজার সম্পর্কে মুম্বইয়ের প্রবাদ এটি নরকের বৈঠকখানা! সাট্টা, মাদকচক্র, নারী ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, দালাল এবং ফড়ের রমরমা।
মুসাফিরখানার ঝুলবারান্দাটা আক্ষরিক অর্থেই ঝুলে রয়েছে! নীচে সার দেওয়া দোকান ইউনানি ওষুধ, দর্জি, সাইকেলের টায়ারের। যার মধ্যে একটি ইসমাইল টেলরিং শপ। মালিক হাজি ইসমাইল মাথা নিচু করে সেলাই করছিলেন কুর্তা। দাউদ সম্পর্কে জানতে চাইছি শুনে আপাদমস্তক মাপলেন। ‘পত্রকার’ পরিচয় দেওয়ার পরেও অনেক ক্ষণ চুপ করে কাজ চালিয়ে গেলেন। তার পর মুখ তুলে কিছুটা স্বগতোক্তির ঢঙেই বললেন, “আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেখানেই এসে দাঁড়াত ‘ভাই’। আমাদের খোঁজখবর নিত নিয়মিত। লম্বা লম্বা সিগারেট ফুঁকে দিত এক টানে। আমাদেরও মধ্যে যথেচ্ছ বিলিয়ে দিত ডানহিল। এখানে তো ঝামেলা লেগেই থাকে। সে সব ঝক্কি সামলাতো অল্প বয়স থেকেই।” ব্যস, মাথা নামিয়ে ফেললেন ইসমাইল। অর্থাৎ, এর বেশি কিছু বলবেন না।
পাশেই ডিসেন্ট সাইকেল শপ-এ দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ইব্রাহিম। পক্ককেশ এবং মানানসই রুপোলি চশমা। আগেই হাজি ইসমাইল অবশ্য বলে দিয়েছিলেন, এই ইব্রাহিমের সঙ্গে নাকি বিশেষ খাতির ছিল দাউদের। দাউদ প্রসঙ্গে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু কতটা চিনতেনএই প্রশ্নের উত্তরে দায়সারা জবাবে কাজ সারলেন ইব্রাহিম। শুধু বললেন, “শুধু আমি কেন এই গোটা মহল্লা চেনে দাউদ ভাইকে। কত বড় হয়ে গিয়েছে। রোজ কাগজে ওর খবর পাই।”
এই উন্নত টেলি-যুগে দাউদের সঙ্গে মহল্লাবাসীদের যোগাযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে সব প্রশ্নে অবশ্য মুখে কুলুপ বাসিন্দাদের। মুসাফিরখানার নীচে ইউনানি ওষুধের দোকানের মালিক বৃদ্ধ, অশক্ত আব্বাস বেগ। থাকেনও এই বাড়িটিতেই। যিনি শুধু বললেন দাউদের বাবা ইব্রাহিম কাসকরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। ব্যস, আর কিছু নয়। শুনেছিলাম এই ভাঙা বাড়িটিতে এখনও থাকেন দাউদের দিদি রোশন আরা।
কিন্তু অনেক চাপাচাপিতেও জানা গেল না, তিনি আদৌ থাকেন কি না। শুধু এটুকুই জানালেন বেগ, এই মুসাফিরখানা কোনও ব্যক্তির মালিকানায় নেই, ছিল না কোনও দিন। কয়েকটি মাদ্রাসা মিলে ট্রাস্ট তৈরি করে অসুবিধায় পড়া মুসলিমদের জন্য এটি চালিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে। অনেকেই সাময়িক ভাবে থাকতে এসে বরাবরের মতো থেকে গিয়েছেন এখানে। পরে মুসাফিরখানার হাতবদল হয়। বাড়িটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলায় বাসিন্দারা ভাড়া হিসাবে সামান্য কিছু টাকা দেন হাইকোর্টে। কিন্তু তার দশ গুণ টাকা নাকি দিতে হয় ‘তোলা’ হিসেবে! কাকে দিতে হয় তোলা? কে আসে নিতে? সদুত্তর দিতে পারলেন না বেগ। অথবা হয়তো চাইলেন না দিতে!
গত কালই দাউদকে পাকড়াও করা নিয়ে পরস্পরকে দূষেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং পি চিদম্বরম। তাকে ধরতে গোপন বাহিনী পাঠানো হবে কিনা সেই বিতর্কে উত্তাল হয়েছে রাজধানী। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একযোগে কাজ করছে। কিন্তু এই ঘিঞ্জি জনপদে দাঁড়ালে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কংগ্রেস বা বিজেপি নয়, সংখ্যালঘুদের মসিহা হয়ে কেউ যদি এখানকার মানুষের মনে থেকে থাকে, তাহলে সে দাউদ। বিজেপি-শিবসেনা তো দূর স্থান, এমনকী কংগ্রেস-এনসিপি জোটেও আস্থা রাখতে পারছে না যে মহল্লা, দাউদ-প্রশ্নে কিন্তু তারাই একজোট! ১৯৯৩-র মুম্বই বিস্ফোরণের আগে সাম্প্রদায়িক অশান্তির স্মৃতি এখনও চোয়াল শক্ত করে দেয় যেখানকার বাসিন্দাদের।
তা হলে কি এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘুরপথে, বকলমে রাজত্ব চলে দাউদের? করাচির ১৮ হাজার বর্গফুটের প্রাসাদ থেকে সে কি নিত্য নজর রাখে তার যৌবনের এই লীলাক্ষেত্রটির দিকে? তার প্রতি এখানকার গোটা মহল্লার এই অকৃত্রিম আস্থার রহস্যটাই বা কী?
ফিরে আসতে হল, প্রশ্নগুলির উত্তর না জেনেই।