জনমন জয় করতে তাঁর যে জুড়ি নেই, এ কথা মানেন সকলেই। বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব স্বীকার করেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর পরে এই প্রথম কোনও নেতা চুম্বকের মতো টেনে রাখতে পেরেছেন জনতাকে। কিন্তু নরেন্দ্রভাইয়ের এই ক্যারিশমা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন আরও কয়েক জন। প্রবীণ ও নবীন।
আজকের জয় সেই টিম মোদীরও জয়। সকলে মোদীর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহের মতো পরিচিত মুখ না হলেও, নেপথ্য কারিগরের শিরোপা তাঁদেরও প্রাপ্য।
কারা তাঁরা? রাজেশ জৈন, হীরেন জোশী, মৌলিক ভগত, অরবিন্দ গুপ্ত, প্রশান্ত কিশোর...।
মোদীর এ বারের প্রচারের অন্যতম বড় মাধ্যম ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। এই সাইবার দুনিয়া সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা, গুজরাতের সিএমও-তে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি রাজেশ জৈন। গোটা দেশে ৩৪৮টি এমন আসন রয়েছে, যেখানে বিজেপি কোনও না কোনও সময় জিতেছে। সেই আসনগুলি বেছে নিয়ে সেখানে মোদী-হাওয়া তৈরি করাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। প্রচারে সেই কেন্দ্রগুলিতেই বাড়তি জোর দিয়েছেন মোদী। রাজেশের সঙ্গেই ছিলেন হীরেন, মৌলিকরা। ৩৪ বছরের প্রশান্ত কিশোর আবার আইআইটি, আইআইএম-এর কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটি পৃথক সংস্থা গড়ে ফেলেন। নাম দেন ‘সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নেন্স’। মোদীর চা-চক্রে আড্ডার ভাবনা তাঁরই। গুজরাতে তৃতীয় বার জয়ের পরে দিল্লির শ্রীরাম কলেজে মোদীর বক্তৃতার আয়োজকও ছিলেন এই প্রশান্তই।
দিল্লিতে মোদী শিবিরের তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান হয়ে কাজ করেছেন অরবিন্দ গুপ্ত। নিজের সফটওয়্যার সংস্থা বেচে বিজেপিতে এসেছেন। শুধুমাত্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী দেখবেন বলে। প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর স্বামী রবার্ট বঢরার বিরুদ্ধে জামাই-রাজার দুর্নীতি ভিডিও তাঁরই তৈরি। এই গোটা টিমের উপরে নজর রেখেছিলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ পীযূষ গয়াল। ‘নমো ফর পিএম’, ‘মিশন ২৭২ প্লাস’-এর মতো প্রকল্পে মেধাবান ছেলেমেয়েদের কাজে লাগানোর দায়িত্ব সামলিয়েছেন পীযূষ।
এ তো গেল প্রযুক্তি। প্রশাসনিক দিক থেকে মোদী যাঁর উপরে সব চেয়ে ভরসা করে এসেছেন, তিনি ১৯৭৯ ব্যাচের আইএএস অফিসার। নাম কে কইলাসান্থন। সকলে চেনেন ‘কে কে’ নামে। মোদীর দফতরে প্রিন্সিপ্যাল সচিব ছিলেন। কিন্তু অবসরের পরেও তাঁকে ছাড়েননি মোদী। গুজরাতে প্রশাসনিক বিষয়ে সব চেয়ে বেশি ক্ষমতা তাঁরই। তার সঙ্গে রয়েছেন ভরত লাল। দিল্লিতে গুজরাতের রেসিডেন্ট কমিশনার। নিঃশব্দে কাজ করায় সিদ্ধহস্ত। প্রতিদিন দিল্লির সংবাদমাধ্যমে মোদীর সমালোচনা করে কী খবর প্রকাশ হচ্ছে, সাত-সকালে মোদীর টেবিলে পৌঁছে দেওয়া তাঁর প্রথম কাজ।
শুধু কি তাই? যে গুজরাত মডেল নিয়ে গোটা দেশে প্রচার করেন মোদী, দিল্লির দরবারে তার সঠিক উপস্থাপন করার কাজটিও সফল ভাবে করে গিয়েছেন ভরত। যার দৌলতে কংগ্রেস মুখে যা-ই সমালোচনা করুক, একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারের পুরস্কার গিয়েছে গুজরাতের ঝুলিতে।
কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা এক বার অভিযোগ করেছিলেন, মোদী নাকি লোকসভা ভোটের প্রচারে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন। সরাসরি তদন্ত করার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন মোদী। তার পর থেকে চুপ কংগ্রেস। কিন্তু ভোট লড়তে যে টাকা দরকার, এই সহজ সত্য সকলেই জানেন। আর এই অর্থ সংগ্রহ ও তা সঠিক ভাবে ব্যবহার করার জন্য মোদী ভরসা করেন সুরেন্দ্র পটেলের উপরে। সকলে তাঁকে ডাকেন ‘কাকা’ বলে। গুজরাতে দলের কোষাধ্যক্ষ তিনি। আর দেশের আর্থিক রাজধানী মুম্বইয়ে মন্ত্রী থাকার সুবাদে আর এক জনও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এগিয়ে এসেছেন এই কাজে। তিনি দলের প্রাক্তন সভাপতি ও সঙ্ঘের আশীর্বাদধন্য নিতিন গডকড়ী।
মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার পথে লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজরা কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়ে মোদীর হয়ে যে দুই নেতা সবথেকে বড় ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা হলেন রাজনাথ সিংহ ও অরুণ জেটলি। বিক্ষুব্ধদের আপত্তি উপেক্ষা করে মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন রাজনাথ। সঙ্গে ছিল জেটলির সমর্থন। বিরোধীদের আক্রমণের লাগাতার জবাব দিতে কাজ করে গিয়েছেন জেটলি। তারকায় গড়া এমন টিম থাকলে জয় তো অনিবার্য হবেই।