বান্দ্রা আদালত চত্বরে সঞ্জীব খন্না। ছবি: পিটিআই।
কলকাতার আলিপুর আদালতে হুবহু এই ছবিটাই দেখেছি বেশ কিছু দিন আগে। স্টিল আর ভিডিও ক্যামেরার ছড়াছড়ি সেই সকাল থেকে। অজস্র মানুষের ধাক্কাধাক্কি। পুলিশে পুলিশে চারদিক ছয়লাপ। আদালত কক্ষে ঠাসা ভিড়।
সেটা ছিল সারদা মামলা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেভিওয়েট মন্ত্রী মদন মিত্রকে তোলা হচ্ছিল আদালতে। আর এই মুহূর্তে দেশজুড়ে সব চেয়ে বেশি তোলপাড় ফেলা খুনের মামলার শুনানিতে আজ মুম্বইয়ের বান্দ্রা আদালতে গিয়ে মনে হল, কলকাতারই ‘রিপিট টেলিকাস্ট’। শুধু কুশীলব পাল্টে গিয়েছে। ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব খন্না, শ্যাম রাই।
শিনা বরা হত্যা মামলার শুনানি শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ৩টে। কোর্টরুমে ভিড় জমা শুরু হল ১২টা থেকেই। ঢোকার পর বিচারক পর্যন্ত কিছুটা বিরক্ত হলেন এমন গাদাগাদি ভিড় দেখে। শিনা মামলার আগে অন্যান্য মামলার শুনানি চলছে। নাম ডাকা হচ্ছে— কেদারনাথ তিওয়ারি, দীপ্তেশ মণ্ডল। এঁরা অন্য মামলার সাক্ষীই হবেন হয়তো। কিন্তু নাম ডাকার পরেও এঁদের দেখা মিলল না। মনে হল, ভিড়ে ঠাসা আদালত কক্ষে ঢুকতেই পারেননি।
৩টের একটু পরেই শুরু হল শিনা মামলার শুনানি। সরকারি আইনজীবী লক্ষ্মণ রাঠৌর জানালেন, এই মামলায় এখনও অনেক তথ্য পাওয়া বাকি। অভিযুক্তরাও পুলিশের সঙ্গে একেবারেই সহযোগিতা করছেন না। তাই তিন জনকেই পুলিশি হেফাজতে রাখা দরকার। ইন্দ্রাণী যে সহজে নতি স্বীকারের পাত্রী নন, আইনজীবীর মাধ্যমে রাখঢাক না করেই সে কথা আদালতে জানিয়ে দিল মুম্বই পুলিশ।
তদন্তকারীরা আগেই বলেছিলেন, শিনা মামলায় তথ্যপ্রযুক্তির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ই-মেল এবং সোশ্যাল সাইটের মাধ্যমে শিনাকে খুনের ছক কষা হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তাঁরা। যে কারণে ইতিমধ্যেই গুগ্ল এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাহায্য চেয়েছে মুম্বই পুলিশ। আজ সরকারি আইনজীবী লক্ষ্মণ রাঠৌর কোর্টে জানান, ইন্দ্রাণীর বেনামে একটি জি-মেল অ্যাকাউন্ট ছিল। সেখান থেকে ২০১২ সালের ৮ মার্চ, ৪ মে এবং ৭ অগস্ট তিনটি মেল পাঠানো হয়েছিল। শিনা খুন হন ২০১২-র ২৪ এপ্রিল। সে ক্ষেত্রে প্রথমটি বাদে বাকি দু’টি মেলই করা হয়েছিল খুনের পর। সেই তিনটি মেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। যা থেকে খুন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে বলে আজ দাবি করেন সরকারি আইনজীবী। তিনি জানান, এমন আরও কিছু ই-মেল পাওয়া যেতে পারে বলে পুলিশ আশা করছে। তাই বেশ কিছু ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল (যার মধ্যে ইন্দ্রাণী, সঞ্জীব ও বিধির ল্যাপটপও রয়েছে) ঘেঁটে তথ্য-প্রমাণ খুঁজতে হচ্ছে।
সরকারি আইনজীবীর কথায়, ‘‘২০১২ সালে খুনের পরে এত বছর কেটে গিয়েছে। অনেক তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ফলে নতুন করে সেই সব প্রমাণ জোগাড় করতে পুলিশের সময় লাগছে।’’ সরকারি আইনজীবী জানান, অনেক সাক্ষীকে এখনও জেরা করা দরকার। খুঁজে দেখা হচ্ছে, মেয়েকে খুন করার জন্য ইন্দ্রাণী কাউকে টাকা দিয়েছিলেন কি না। দিয়ে থাকলে, নির্দিষ্ট এক জনকে দিয়েছিলেন না অনেককে? কত করে দিয়েছিলেন? সরকারি আইনজীবী জানান, ১৪টি ক্রেডিট কার্ড ছিল ইন্দ্রাণীর। সেই কার্ড মারফত কোনও লেনদেন হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। মুম্বই থেকে লন্ডন— ইন্দ্রাণীর বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
সূত্রের খবর, গাড়িচালক শ্যাম রাইকে নাকি সাত লক্ষ টাকা দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। শ্যাম দাবি করেছেন, এর মধ্যে মাত্র দেড় লক্ষ টাকা পান তিনি। এ নিয়ে জেরার মুখে তিনি অসন্তোষও প্রকাশ করেন। পুলিশ সূত্রের দাবি, শ্যাম দাবি করেছেন, ইন্দ্রাণী শেষের দিকে দেশ ছাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। সেই সময়ে বাকি টাকা চাওয়ায় ইন্দ্রাণী তাঁকে বলেছিলেন ‘তৈরি’ থাকতে। শ্যামের দাবি, তাঁকেও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। বলেছিলেন, তাঁর ছেলেকে বিদেশে চাকরি করে দেবেন। এর জন্য তাঁর কাছ থেকে পরিবারের সকলের ছবিও নিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী।
শিনাকে খুনের আগে গাড়ি নিয়ে মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জায়গা ‘রেকি’ করে এসেছিলেন ইন্দ্রাণী। পুলিশের দাবি, শিনার দেহ কোথায় পোঁতা হবে, তা খুঁজতেই বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছিলেন তিনি। শেষে বেছে নেন রায়গড়। কেন রায়গড়, তারও সদুত্তর মেলেনি বলেই সরকারি আইনজীবী জানান। তবে তিনি বলেন, ‘‘এই খুনের ঘটনা শুধু মুম্বইয়েই সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে রয়েছে মহারাষ্ট্র, কলকাতা, গুয়াহাটি-সহ আরও অনেক জায়গায়। তার উপরে অভিযুক্তেরা তদন্তের কাজে পুলিশকে সাহায্য করছেন না।’’
পাল্টা সওয়ালে ইন্দ্রাণীর আইনজীবী গুঞ্জন মঙ্গলা বলেন, ‘‘পুলিশ তো বিচারের আগেই ইন্দ্রাণীকে ‘খুনি’ বলে দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমেও বেরিয়ে যাচ্ছে, তিনি নাকি খুন করেছেন। এখনও বিচার শেষ হয়নি। জেল হেফাজতে থাকলে তিনি কী করে সাক্ষীদের প্রভাবিত করবেন?’’ গুঞ্জনের অভিযোগ, ২০১২ সালে মৃতদেহ উদ্ধার করার পরে রায়গড়ের পেন থানা সেটি ময়না-তদন্তে পাঠিয়েছিল। সেই ময়না-তদন্ত ও ফরেন্সিকের রিপোর্ট এখনও পুলিশ হাতে পায়নি। তাঁর কথায়, ‘‘এই যদি মুম্বই পুলিশের দক্ষতার মাপকাঠি হয়, তা হলে এখন কী রকম তদন্ত হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।’’
বিচারক অবশ্য তিন অভিযুক্তকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতেই রাখার নির্দেশ দেন। বিকেল সাড়ে ৪টে। বান্দ্রা আদালত থেকে তিন অভিযুক্তকে ফিরিয়ে আনা হয় খার থানায়। সেখানে আগে থেকেই জেরা করা হচ্ছিল ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন সঙ্গী সিদ্ধার্থ দাসকে। তবে মিডিয়া ব্যারন পিটার মুখোপাধ্যায়কে তিন দিন জেরার পরে আজ থানায় ডাকা হয়নি।
রাত বাড়তে থাকে। কোর্ট থেকে ভিড়ের ঠিকানা আবার খার থানা চত্বর। গত কয়েক দিনের মতোই!