এখন অনেকটাই সুস্থ সোনু (ডান দিকে)। গল্প চলছে ‘ভাইয়া’ অনীশের সঙ্গে।— নিজস্ব চিত্র।
এ-ও আর এক ভাইজানের গল্প।
তবে কোনও মূক শিশু নয়, এই গল্পে ‘ভাইয়া’ অনীশ আইয়ারের সঙ্গে রয়েছে মস্তিষ্কের গুরুতর রোগে আক্রান্ত সহায়সম্বলহীন কিশোর সোনু মুর্মু। তার বাড়ি পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডে। কলকাতার রাস্তায় অসুস্থ অবস্থায় সোনুকে ‘আবিষ্কার’ করার পরে শুধু তার চিকিৎসার ব্যবস্থাই করেননি অনীশ, তাকে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দিতে একাই ছুটে বেরিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের একাধিক জেলায়। শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করেছেন সোনুর ‘বাড়ি’। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে ফিরে যাবে ওই কিশোর।
‘‘সোনুকে নিয়ে অনীশকে পাকিস্তানে যেতে হয়নি ঠিকই, তবে তাঁকেও কিছু কম দৌড়তে হয়নি,’’ বলছিলেন সল্টলেকের এক সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমের কর্মী। এই হোমেই রয়েছে সোনু। যখন তিনি এ কথা বলছেন, হোমের বাইরের ঘরের সোফায় বসে তখন আঙুলে আঙুল জড়িয়ে খুনসুটি করছে দু’জনে। বয়সের ভালই তফাত। অনীশের বছর বত্রিশ বয়স। আর সোনু সবে তেরো। ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরিবারের ছেলের সঙ্গে ভাষাতেও মেলার কথা নয় মালয়ালি অনীশের। তবু অটুট বন্ধুত্ব দু’জনের। কখনও অনীশের সঙ্গে কানে কানে ফিসফিস করে কথা বলছে সোনু। কখনও চোখ বুজে শুয়ে পড়ছে তাঁর কোলে মাথা দিয়ে।
এই নির্ভরতার পিছনে রয়েছে সোনুকে খুঁজে পাওয়ার কাহিনি। তা কোনও অংশে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর থেকে কম নয়, বলছেন এখন অনেকেই। সেলুলয়েডের গল্পে সলমন খান হনুমান তথা বজরঙ্গবলীর এক মেলায় খুঁজে পান মূক শিশু শাহিদাকে। তার পর বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে অনেক বাধা পেরিয়ে তাকে পৌঁছে দেন সীমান্তের ও পাড়ে, পাকিস্তানে মেয়েটির নিজের বাড়িতে। সোনুকে অনীশ প্রথম দেখতে পান শরৎ বসু রোডের ধারে, ফুটপাথে। সেখানে শুয়ে ছটফট করছিল সে। খিঁচুনি হচ্ছিল তার, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিল। সেটা ৭ জুন। যোগ শিখে বাড়ি ফেরার পথে অপরিচিত একটি ছেলেকে এ ভাবে পড়ে থাকতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। আশ্চর্য হয়ে দেখেন, পথচারীরা কেউই সে দিকে তাকিয়ে দেখছে না।
অনীশ এড়িয়ে যেতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি ডেকে সোনুকে তিনি নিয়ে যান ডাক্তারের কাছে। তার পর নিজের বাড়িতে। তখনও তিনি জানেন না, ঝাড়খণ্ডের এক সাঁওতাল পরিবারের সন্তান সোনু। জানেন না, তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে ওই রাজ্যেরই সাহেবগঞ্জ এলাকায় লীলা মিশন স্কুলের হস্টেলে থাকত সে। চিকিৎসকেরা পরে সোনুকে পরীক্ষা করে জানান, মস্তিষ্কের কোষ শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলেটির। তাই স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আটকে যাচ্ছে কথা। কোনও কিছু বোঝা বা প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতাও ধীরে ধীরে হারাচ্ছে সে। কী ভাবে সাহেবগঞ্জের হস্টেল থেকে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে সে কলকাতায় এসেছিল, তা-ও পুরোপুরি রহস্য।
এ সব কথাই ধীরে ধীরে জানতে পেরেছেন অনীশ। তবে ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসার পর খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথমেই যেটা জানতে পারেন, সেটা হল: এই ধরনের রোগে আক্রান্ত অনাথদের জন্য কলকাতায় কোনও হোম নেই। তখন সোনুকে নিজের বাড়িতে রাখতে সমাজকল্যাণ দফতর ও কলকাতা শিশু নিরাপত্তা কমিটি-র (সিডব্লিউসি) থেকে বিশেষ অনুমতি জোগাড় করেন। কলকাতার শিশু নিরাপত্তা অফিসার সীমা সরকার বলছিলেন, ‘‘কলকাতায় তো বটেই, গোটা পশ্চিমবঙ্গেই অসুস্থ শিশুদের রাখার হোম প্রায় নেই বললেই চলে। তাই প্রথম যখন অনীশ ওই কিশোরকে সঙ্গে করে আনেন, তখন তাকে কোথায় রাখা হবে ভাবতে গিয়ে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম।’’ পরে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে সোনুকে বাড়িতে রাখার ব্যপারে অনীশকে অনুমতি দেন তাঁরা।
এর পরই অনীশ যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করেন সোনুর সঙ্গে। তার অসংলগ্ন ভাঙা কথা থেকে জানতে পারেন, সে পড়শি রাজ্যের বাসিন্দা। সেই সূত্র ধরেই ছুটে বেড়ান ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গায়।
অবশেষে খুঁজে বের করেন সাহেবগঞ্জের সেই হস্টেল।
একা একটা মানুষকে এক অনাত্মীয়ের জন্য এ ভাবে উদ্যোগী হতে দেখে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সমাজকল্যাণ কর্তারাও। সকলের চেষ্টায় আর কিছু দিনের মধ্যেই নিজের পুরনো জায়গায় ফেরানো হচ্ছে ওই কিশোরকে। সাহেবগঞ্জের শিশু নিরাপত্তা অফিসার পুনম কুমারীর কথায়, ‘‘ওই যুবক যা করেছেন, তা কল্পনা করা যায় না এই যুগে।’’
অনীশ নিজে কী বলছেন? সোনুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছিলেন, ‘‘আমার পক্ষে একটা অসুস্থ বাচ্চা ছেলেকে নির্বান্ধব শহরে একলা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। ও তবে মারা যেত। গত আড়াই মাসে ৩ বার হাসপাতালে থাকার সময় ছাড়া আমরা একসঙ্গে ঘুরেছি, খেলেছি, সিনেমা দেখেছি, ছবি এঁকেছি। ওকে ছাড়া থাকতে অসুবিধা হবে আমার।’’
সে জন্যই সোনুও এখন পুরোপুরি অনীশের উপর নির্ভরশীল। সল্টলেকের ওই হোম, যেখানে সে রয়েছে গত কয়েক দিন, তার ঘরে বসে নতুন ‘ভাইয়া’কে সে বলে রেখেছে, সাহেবগঞ্জের হস্টেলে ফেরত গেলেও তার মন পড়ে থাকবে এই কলকাতায়, শুধু অনীশের জন্য!