বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছেন অসম ও বিহারের তরুণ গগৈ এবং নীতীশ কুমার। ইস্তফা না-দিলেও নজিরবিহীন ভরাডুবির দায় প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। প্রকাশ কারাট, বিমান বসুরা এর কোনওটাতেই নারাজ! বেনজির বিপর্যয়ের নৈতিক দায় পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের কাঁধে নিতে রাজি নন!
কমিউনিস্ট পার্টি যবে থেকে এ দেশে সাধারণ নির্বাচনে লড়ছে, তার মধ্যে এ বারের ফল সব চেয়ে খারাপ। ভোটে হতাশাজনক ফল হলে যে কোনও দলেই নেতৃত্বের দিকে আঙুল ওঠে। সিপিএমেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গে। ২০০৯-এর লোকসভা, ২০১১-র বিধানসভা এবং এ বারের লোকসভা ভোটে যাঁদের নেতৃত্বে উপুর্যপুরি ভরাডুবি হল, তাঁরা দায় স্বীকার করে সরে দাঁড়াবেন না কেন প্রশ্ন প্রবলতর হতে শুরু করেছে বাম শিবিরে।
এমন বিপর্যয়ের ধাক্কার মধ্যেই আজ, রবিবার দিল্লিতে বসছে সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক। তবে সেখানে না নেতা, না নীতি কোনওটাই বদলের সম্ভাবনা নেই! পলিটব্যুরো বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগে শনিবারও পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে এ ভাবে কাজ হয় না। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট আগের দিনই জানিয়ে রেখেছেন, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্ব কারওরই নৈতিক দায় নেওয়ার দরকার নেই! মুখ বদলে সংগঠনে অন্তত ঝাঁকুনি দিতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কর্মীদের লড়াইয়ে রাখা যাবে কী ভাবে, দল ও বামফ্রন্টের ভিতরেই তা-ই নিয়ে ক্ষোভ আরও ধূমায়িত হচ্ছে।
এমন নয় যে, নেতা বদলে দিলেই বামেরা সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু যাঁরা বদল চান, তাঁদের যুক্তি: বারবার সামনে দেখে অভ্যস্ত মুখ সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনলে জনমানসে অন্তত একটা বার্তা দেওয়া যাবে। নয়তো মানুষ মনে করছেন, বারবার ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়েও বাম দলগুলি আসলে অচলায়তন হয়ে রয়ে গিয়েছে! আবার সিপিএম নেতৃত্বের একাংশের পাল্টা যুক্তি: আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও বিপর্যয় ডেকে আনার অর্থ হয় না। আর কয়েক মাস পরেই সিপিএমের সম্মেলন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এত নির্বাচনী বিপর্যয় এবং সাংগঠনিক বাধ্যবাধকতার কারণে তখন এমনিতেই নেতৃত্বের বদল হবে। তার আগে তাড়াহুড়ো করে কী লাভ? সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “শুধু বদলের জন্য বদল করতে গেলে নৈরাজ্য হবে!”
বামেদের বন্ধু, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কারাটদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছিলেন। তাঁদের বিকল্প সরকারের ভাবনা মানুষ গ্রহণ করেনি বলে বাম নেতারা স্বীকার করছেন। সেই একই উদ্যোগে ১১টি দলের শরিক ছিলেন নীতীশও। তিনি দায় নিয়ে সরে দাঁড়াতে পারেন আর নীতি-নির্ভর রাজনীতির কথা বলেও বামেরা পারেন না প্রশ্ন এখন বাম শিবিরেই।
এর সঙ্গে সঙ্গেই আরও বড় প্রশ্ন, পরপর ভোটে পথে বসার পরে সামনের পথ কী হবে? অপ্রত্যাশিত হারের পরে বাম কর্মী-সমর্থকেরা এখন স্তম্ভিত। পশ্চিমবঙ্গে বাম নেতাদের একাংশ মনে করছেন, আপাতত অন্য কর্মসূচি মুলতবি রেখে বুথভিত্তিক সংগঠন ঠিক করার দিকেই জোর দেওয়া ভাল। তা হলে অন্তত দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে কিছু আসন চিহ্নিত করে ভাল লড়াই দেওয়া যাবে। পরিবর্তনের হাওয়া সামলে তিন বছর আগে রাজ্যে বামফ্রন্ট জিতেছিল ৬১টি আসন। তার পরে বিধায়কের মৃত্যু, উপনির্বাচনে হার, বিধায়কদের দলবদল, এ সবের জেরে আসন কমেছে। এ বারের লোকসভা ফলের নিরিখে দেখলে বামেরা এগিয়ে মাত্র ২৯টি আসনে! প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি ধরে রাখাও দুষ্কর সিপিএমের পক্ষে! সংগঠন সামলানো না গেলেও ২০১৬-য় কী হবে, ভেবে শিউরে উঠছেন বাম নেতাদের এই অংশ।
আবার বামেদের অন্য একাংশের মত, লোকসভা ভোটে তৃণমূল যতই সাফল্য পাক, রাজ্যে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার মতো নানা বিষয় আসতেই থাকবে। সারদা, টেট, নারী নির্যাতনের মতো বিষয়ে আন্দোলন ছেড়ে হারের ধাক্কায় বামেরা ঘরে বসে গেলে বিরোধী পরিসর দখল করবে বিজেপি। এমনিতেই রাজ্যে বাড়তি ভোট পেয়ে তারা উজ্জীবিত। তাই আন্দোলনের পথেই থাকতে হবে। কারাটও এই মতের শরিক। এক বাম নেতার কথায়, “এখনই মিছিলের ডাক দিলে লোক আসবে না। ঘর থেকে অনেক কর্মী-সমর্থক হয়তো বেরোবেন না। যাঁরা আসবেন, তাঁদের হয়তো পুলিশ দিয়ে তুলে দেওয়া হবে। তবু পথেই থাকতেই হবে!”
এ সবই অবশ্য অদূর ভবিষ্যতের পথের কথা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দাওয়াই? প্রাগৈতিহাসিক আমলের ভাবনাচিন্তা ছেড়ে নিদেনপক্ষে হাল আমলে অন্য দেশের কমিউনিস্টদের পথের দিকেও কবে নজর দেবেন কারাট-বিমানেরা, তার কোনও উত্তর নেই। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বা সরকারি বিনিয়োগের জন্য সওয়াল করা ছেড়ে পরিবেশ আন্দোলনের কথা কবে ভাববেন, কোনও ইঙ্গিত নেই তাঁদের ভাবনাচিন্তায়। নতুন প্রজন্মকে কাছে টানার মতো পরিকাঠামো গত ব্যবস্থাও বামেরা করতে পেরেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে বিস্তর। সিপিএমের কর্মী মহলেরই একাংশের ক্ষোভ, মাত্র কয়েক হাজার টাকার ভাতার বিনিময়ে সর্বক্ষণের কর্মী হতে আজকের দিনে কে আসবেন? কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালবেসে এক কালে অনেকে দিন-রাত এক করে কাজ করতেন। কিন্তু সে সবই সুদূর অতীত। এখন নতুন জমানায় ক্যাডার-নীতি বা যুুগোপযোগী করা হবে না, কেন প্রশ্ন উঠছে।
দীর্ঘমেয়াদি এ সব প্রশ্ন ছেড়ে বাম নেতারা অবশ্য জোড়াতালি দিতেই ব্যস্ত! তৃণমূল, বিজেপি না কংগ্রেস, মূল প্রতিপক্ষ কে বামেদের প্রচারে তার দিশা ছিল না, এমন কথাই ফের ঘুরেফিরে আসছে। কংগ্রেসের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে গিয়ে দলের একাংশ বিপর্যয় ডেকে আনলেন কি না, সেই প্রশ্নও আছে। যে কারণে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ার ফায়দা অনেকে পেলেও বামেরা পেল না। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি মেনে নিয়েছেন, “মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তা থেকে বামেরা নির্বাচনী ফায়দা তুলতে পারেনি।” ত্রিপুরা ও কেরলে তুলনায় সাফল্যের কথা উল্লেখ করেও ইয়েচুরি কবুল করেছেন, “দুর্বলতাগুলো খুঁজে বার করে তা কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন, এই নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
স্পষ্ট ছিল বহু দিন ধরেই। কিন্তু আসল রোগে নজর না দিলে দাওয়াই আর কী হবে! এই প্রশ্ন রেখেই আজ বসছে পলিটব্যুরো। সেখানে শুধু নির্বাচনী ফলাফলের প্রাথমিক পর্যালোচনা হবে। এর পরে রাজ্য কমিটিগুলোর রিপোর্ট নিয়ে ৭-৮ জুন বসবে কেন্দ্রীয় কমিটি। অর্থাৎ সেই একই গতানুগতিক ধারা!