এই পৌষের দুপুরে তিনশো বছরের কলকাতা তার আশপাশের ছোট শহর-মফস্সলের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা তিন বন্ধু, প্রবীর আমি আর জয়দীপ। তোমাকে এ লেখা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল দু’একটা কথা, দু’একটা লাইন—তুমি আসতে চাও? এসো, কার কী বলবার আছে তাতে।/তুমি নিতে চাও? নাও। কী নেবে? যা খুশি!/ দুদিন বাড়িতে একা। আর কেউ নেই।/সূর্য একমাত্র সাক্ষী। সেও বলছে আমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে/রাজি!/ চিলেকোঠা রোদে ভাসছে। সুন্দর, এসেছ আজ প্রাতে/আমিও তোমার হাতে চরিত্র খোয়াতে বসে আছি!
এই যে সুন্দর এসেছ আজ প্রাতে। এই সুন্দরই পৌষ। রৌদ্র এসে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই শহর। গড়ের মাঠের দিকে যাওয়া যাক। ঘন গভীর সবুজে সবুজ শ্যামলে শ্যামল ময়দানের মধ্যে দিয়ে চলেছে ট্রাম। যে দিকে তাকাও সে দিকেই খেলা চলেছে। তরুণ-তরুণী হাতে হাত রেখে চলেছে গঙ্গার দিকে। বাদামওয়ালা চলেছে, চলেছে দু’ঘোড়ায় টানা ঝলমলে সব ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তায় তাদের কপাকপ শব্দ শুনে মনে হয়—আহা কী শুনিলাম জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না। দিন দিনান্তের প্রতিদিনকার সবটাই যেন পৌষ এসে নতুন ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে। আমরা তিন বন্ধু এসে পড়লাম ডায়মন্ডহারবারে গঙ্গার মোহনার কাছে একটি রিসর্টে। বড় বড় জাহাজ চলেছে সাগরের দিকে। রিসর্টের অনেকটা মাঠ পেরিয়ে গঙ্গার পাড়ে কাঠের ছোট ছোট ঘর, আমরা সেই ছোট কাঠের ঘরে বসে ভাবছি এ বার সোনালি তরলে চুমুক দেওয়া যায় কি না। কিন্তু হায় আমরা খেয়ে ফেললাম কফি। আমরা তিন জনে দিগন্তের দিকে সোজা চেয়ে রয়েছি। পৌষের বাতাস গঙ্গার ওপর দিয়ে এসে পড়ছে আমাদের গায়ে। রোদ্দুরে ঝকঝক করছে গোটা পৃথিবী। তখনই মনে হয়—আর এই তো যৌবন। আমরা সেখানে বসে ঠিক করি—চল আমরা শান্তিনিকেতন যাই।
বেরিয়ে পড়লেই তো হল। ট্রেন বাঁক নিচ্ছে গুসকরা থেকে লাল মাটির দেশে। পিচকুড়ির ডাল, শেয়াদার ঢাল পেরিয়ে অবশেষে শান্তিনিকেতন। মনে হল যেন—হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে। ঠিক তখনই প্রশ্ন জাগে, প্রশ্ন জেগে উঠল তবে কেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে শিউলিগুলি ভয়ে মলিন। সুবর্ণরেখা, ছাতিমতলা, ঘণ্টাঘর, কালোবাড়ি, সনতের কচুরির দোকান, কালোর চা থেকে কোপাই—সর্বত্রই খালি বিধাতার উপুড় করে দেওয়া হাতের স্পর্শ। যেন মনে হয়—এত আয়োজন সব আমাদের জন্য। এই যে আমরা তিন বন্ধু এসেছি আমাদের জন্যই যেন সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা সোনাঝুরির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকি। একের পর এক তরুণ শালবৃক্ষকে পেরিয়ে যাই। চোখে পড়ে মৃত এক বাঁধ, সেই বাঁধের রাস্তা যেন এক কোথায় চলে গেছে। রৌদ্র গায়ে মেখে আমাদের পথ পেরনো চলতেই থাকে। পথ না রাস্তা, রাস্তা না পথ—কে জানে? আসলে পথিক শব্দটা বড়ই সুদূর ও রহস্যময়। এখন তো আমরা পৌষেরই পথিক।
ও, বান্দ্রা-লোলাভালা, জুহুর পাঠিকা, আমি কখনও তোমার শহর দেখিনি। তুমি কিন্তু সমুদ্রের পাড়ে বসে ভাবতেই পারছ না আমি কত সুন্দর একটা ঋতুর মধ্যে দিয়ে দুই বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমিও এস না আমাদের সঙ্গে। এ বারে যেন পৌষ এসে ভরে দিয়েছে ইলামবাজার জঙ্গল। লালে লাল খয়েরি লাল কমলা লাল যেন ভরে গেছে কোণে কোণে। মান্না দে যেন কোথা থেকে গেয়ে উঠলেন—না না যেও না ও শেষ পাতা গো শাখায় তুমি থাকো,/ ছিলে তুমি ছিলাম আমি চিহ্নটি তার রাখো। কিন্তু কবি ও তার কবিতা জানাচ্ছে অন্য কথা—কাল সন্ধে কোথায় ছিলে ও মোর দরদিয়া/তোমার জন্য প্রাণনাথ গো রেখেছি ধরে হিয়া/ হিয়ার ভেতর পোড়ে কেন জ্যোত্স্নারঙা আগ/পৌষ-মাঘের চরণ দুটি বক্ষে ফেলে দাগ। তা হলে দেখা যাচ্ছে পৌষ-মাঘ চরম হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের চারপাশের ভেসে চলা জীবনে, যে জীবন ফড়িঙের-দোয়েলের......।
আমরা তিন বন্ধু যাচ্ছি ইলামবাজার জঙ্গল পেরিয়ে পানাগড় হয়ে ডান দিকে ঘুরে আসানসোলের দিকে। আসানসোলে যাব কি না-তাও সন্দেহ মনে হয়। এমনও তো হতে পারে আমরা উখড়া মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে চলে যাব পাণ্ডবেশ্বর। পৌষে এই মফস্সল শহর যেন নতুন ভাবে সেজে থাকে। সবই একই দিন কিন্তু পৌষ মানে শীতের মুখ থেকেই যেন তার চেহারা অন্য রকম হয়ে যায়। আরও আরও ভেতরে যাই চলো। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট টিলা। রাস্তার দু’পাশ সবুজ হয়ে আছে। আকাশ নীল যেমন ছিল যখন হিউয়েন সাং কিংবা মার্কোপোলো এসেছিলেন। গাড়ি চলেছে, আমাদের কথা বন্ধ। মুখে সিগারেট নেই। শুধু চোখ ভরে দেখছি দেবতার আশীর্বাদ যে দিকে তাকাই সর্বত্র। চমত্কৃত হতে হয়, আশ্চর্য লাগে কখন কী ভাবে কেমন করে বদলে যায় সব। আমরা আবার গাড়ি ঘোরাই। চল পৌষমেলায় যাই চল। সেখানে কত গান শোনা যাবে। নিজেদের মধ্যে তূরীয় আনন্দে নিজেরাই গান ধরব—তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না/ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাব না। মেলার মাঠ ঘুরে ঘুরে চপ খাওয়া হবে, জিলিপি খাওয়া হবে। তিন জন তিন জনকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করব—প্রবাসে নিয়ম নাস্তি আমরা জানি, তাই আমরা কি এ বার নিজেদের দুষ্টুমি শুরু করব। আচমকাই কার্তিকের সঙ্গে দেখা। কার্তিক দাস বাউল। এক মুখ দাড়ি, এক মুখ হাসি। বললে—আপনাদের পৌষ আর আমাদের পৌষ অনেক আলাদা। আমাদের পৌষ অনেক আপন। আপনারা শহরের লোকেরা পৌষকে উপভোগ করতে পারেন না। সেই গাড়ি-ধোঁয়া-ধুলো-মিটিং-মিছিল-মারপিট-বন্ধ এ সব নিয়েই ব্যস্ত। আর আমাদের দ্যাখেন আমরা পিঠা বানাই, পুলি বানাই, ঘরের দেওয়ালে আলপনা দিই, আঙিনা নিকাই, বড়ি দিই, কাঁথা বানায় আমাদের বাড়ির মেয়েরা, আমরা গলায় বাঁধি।
পাণ্ডবেশ্বর
ইলমবাজার
আমাদের নিয়েই কবি বলেছে—সুর তো ফকির, চলে ধুলো পায়ে গ্রাম থেকে গ্রামে/সুরের মাথায় চূড়া জরোয়ার দিগরের নামে/সুর তো গাছের পাতা উড়ে পড়ে জলে সহজিয়া/বাউলে বীরভুম মাতে দাওয়া ঘোরে কীর্তনে নদিয়া/গানের মানুষ আমরা, সব গোত্র হারানো কাশ্যপ/নিকিরি কৈবর্ত বাগদি কলু জোলা নমঃশূদ্র সব/আমাদের উপবীত ছিঁড়ে উড়ছে রামধনু আকাশে/আমরা দ্বিজোত্তম, আমরা গাইতে উঠি চোলপুরের বাসে/সুর দোয়া করো সুর আজ্ঞা দাও ট্রেনের কামরায়/আমরা ঘরের গানে যেন সব ঘর ভরে যায়। এতটা বলে কার্তিক দাস বাউল থামল। খানিক দম নিয়ে বলল, জানেন এ কবিতা লেখা হয়েছিল আমাদের এই পৌষ মাসে। ও পাঠিকা, সমুদ্রের জলরাশি দেখতে দেখতে এই দুর্বল লেখা পড়তে তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে। কিন্তু আমরা তিন বন্ধু এক আশ্চর্য পৌষ মাস খুঁজে পেয়েছি। যার ভিতরে শুধু সৌন্দর্য আর সৌন্দর্য। আমরা কখন যেন ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি টাকির তীরে। সামনে বিশাল ইছামতী। নদীর ও পারে বাংলাদেশ। আমাদের স্বপ্নের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বাংলাদেশ। কয়েক জন রাজনৈতিক নেতার ইচ্ছায় নদীর দুটো পাড় দুটো আলাদা দেশ হয়ে গেল। এই শীতের মুখে কত লোক এসেছে বেড়াতে। কত মানুষ এসেছে পরিবার নিয়ে পিকনিক করতে। এখানে নৌকা নিয়ে অনেক দূর অবধি ঘুরে আসা যায়। এখানে শীতের সূর্য গায়ে যেন তার আলো দিয়ে সোয়েটার পরিয়ে দেয়। পাঠিকা, তোমাকে একটা শীতের একটা পৌষের একটা মাঘের কবিতা শোনাই—ঘন কলাই ডালের বাটি পাতিলেবুর গন্ধ কী অমৃত/সবজে কাঁচা লঙ্কাটিকে বোন আনল উঠোনবাগান থেকে/ গোল হয়ে সব রান্নাঘরে কাঁসার বাসন দেখে/রোদ বলেছে ঝলক দিয়ে একটা থালা আমায় যদি দিত/রোদ একা নয় শীতের হাওয়া পুকুর জলের ঘ্রাণ/পাড়ার বেড়াল ভুগ্লু কুকুর সক্কলে এই বাড়ি/ খাওয়ার সময় আগেই আসে রান্নাঘরের টান/জানালা দিয়ে চড়ুই শালিখ বারণ করতে পারি/থালার ওপর স্বর্গ তার দু চার মুঠো প্রাণ/ছড়িয়ে যাক শহর শহর পল্লি জগত্বাড়ি।
ডায়মন্ড হারবার
হয়তো তুমি আমায় প্রশ্ন করবে, হয়তো তুমি জিজ্ঞেস করবে। সে কারণেই বলি—আজ যদি আমায় জিজ্ঞেস করো শত শত লাইন ধরে তুমি মিথ্যে লিখে গিয়েছ কেন? যদি জিজ্ঞেস করো একজন লেখকের কাজ কী হওয়া উচিত। কেন তুমি এখনও শেখোনি? তাহলে আমি বলব মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর দিয়ে কেবল উড়েই বেড়াইনি, পৌষের এই ভোরবেলা কুয়াশায় শীত শীত হাওয়ায় শীত শীত বাতাসে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেড়িয়েছি মাঠে আর জনপদে।
সুন্দরী বিদূষী পাঠিকা, তুমি একবার চায়ের কাপে চুমুক দাও। আমরা তিন বন্ধু এ বার শহরে ফিরি। আমাদের কল্লোলিনী তিলোত্তমায় ফিরে আসি। কত জায়গা দেখে দেখে আমাদের মন ভরে গেছে। সব তো আমাদের জন্যই রেখেছিলেন প্রকৃতিদেবী। এই শহরে ফিরে শহরটাকেও খুব ভাল লাগে। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে চলেছে ভুটানীদের সোয়েটারের মেলা। শিয়ালদা কলেজস্কোয়্যারে চলেছে বিদেশি পাখি ও বিদেশি মাছেদের মেলা। পার্কস্ট্রিটে আবার অনেক দিন পরে গ্যাসবেসুনওয়ালা এসেছে। মানুষের ঢল চলেছে চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘরের দিকে। ফুলকপির পাকোড়ার সঙ্গে ম ম করছে পাড়ার তেলেভাজার দোকান। বইমেলা আসছে, বইমেলা। বাইপাসের কাছে মিলনমেলায় বসবে বইমেলা। কলকাতা থেকে কোচবিহার—তখন সমস্ত রাস্তা গিয়ে মিশবে ওই বইমেলায়। সেখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। বাকি দুই বন্ধুকে না এনে আমি একা যাব তোমার সঙ্গে দেখা করতে। এই পৌষে কথা দাও, ও পাঠিকা, আমার এখনও তোমাকে চোখে না দেখা পাঠিকা, তুমি সত্যিই আসবে তো।