নীরবেই শেষ হয়ে গেল মনমোহন-জমানা

নেহরু-ইন্দিরার পর এ যাবৎ তিনিই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে রইলেন। এক টানা দশ বছর। তা ছাড়া দেশ ভাগের আগে অবিভক্ত পঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসাও তো এক উত্থানেরই কাহিনি। কিন্তু ৭ রেস কোর্স রোড থেকে বিদায় মুহূর্তে আজ সেই গৌরব কি ধরে রাখতে পারলেন মনমোহন সিংহ? লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপুল ভরাডুবির পর আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন মনমোহন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০৩:২০
Share:

নেহরু-ইন্দিরার পর এ যাবৎ তিনিই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে রইলেন। এক টানা দশ বছর। তা ছাড়া দেশ ভাগের আগে অবিভক্ত পঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসাও তো এক উত্থানেরই কাহিনি। কিন্তু ৭ রেস কোর্স রোড থেকে বিদায় মুহূর্তে আজ সেই গৌরব কি ধরে রাখতে পারলেন মনমোহন সিংহ?

Advertisement

লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপুল ভরাডুবির পর আজ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন মনমোহন। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাঁর ইস্তফাপত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেন রাষ্ট্রপতির হাতে। তার আগে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেন, “দশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব যখন নিয়েছিলাম, তখন অধ্যবসায়ই ছিল আমার হাতিয়ার, সততাই ছিল পথ। দেশের যাতে ভাল হয়, সে জন্য সর্বদা চেষ্টা করেছি।”

যদিও নরেন্দ্র মোদীর জয়ে আমোদিত রাজনৈতিক পরিবেশে মনমোহনের এই আনুষ্ঠানিক বিদায় আজ নিছক এক পার্শ্বদৃশ্য হিসেবেই থেকে গিয়েছে।

Advertisement

৭ রেস কোর্স রোড থেকে মনমোহনের বিদায় নিয়ে দৃশ্যত কোনও হেলদোলও হয়নি রাজনীতির অলিন্দে। এক রকম নীরবেই বিদায় নিতে হল এক দশকের প্রধানমন্ত্রীকে! কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল আজ মনমোহন সিংহের সাফল্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানান, পরমাণু চুক্তি রূপায়ণ, সার ও পেট্রোপণ্যের মূল্যের বিনিয়ন্ত্রণ, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর সরকার। সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার বিষয়টিকেও মনমোহন নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সিব্বলের কথায়, “এ সব কারণে সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তাঁর নাম মনে রাখবে ইতিহাস।”

একাধিক রাজনৈতিক নেতা অবশ্য বলছেন, মনমোহনের মর্যাদা আসলে কংগ্রেসই খাটো করেছে। কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের প্রথম জমানা থেকেই মনমোহনকে দুর্বল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কটাক্ষ করেছিল বিজেপি। কিন্তু তাতে মনমোহনের মর্যাদা কমেনি। তাঁর নেতৃত্বও দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়নি। বরং বামেদের আপত্তি-হুমকি উপেক্ষা করে যে

ভাবে তিনি আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সই করেন, তাতে বিরোধীরাও মনমোহনকে কুর্নিশ করেছিলেন। তাঁকে সামনে রেখেই কেন্দ্রে

দ্বিতীয় বার সরকার গড়ে কংগ্রেস। তখন এই মনমোহনকেই ‘সিং ইজ কিং’ আখ্যা দিয়েছিল দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমও।

কিন্তু গোলমালটা বাধল দ্বিতীয় দফার সময় থেকেই। বিরোধীরা তো বটেই, কংগ্রেসের অন্দরেও অনেকে মনে করেন, তখন থেকেই দলে এবং সরকারে মনমোহনের অমর্যাদা শুরু হল এবং গাঁধী পরিবারের হাত ধরে তা এক সময় চরমে পৌঁছে গেল। মনমোহনের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু-র সদ্য প্রকাশিত বইয়েও স্পষ্ট বলা হয়েছে, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর অঙ্গুলিহেলনেই চলত মনমোহন-সরকার। সংস্কার থেকে শুরু করে একাধিক বিষয়ে চেয়েও এগোতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যেই গত বছর, প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ সফরে, তখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত অর্ডিন্যান্স ছিঁড়ে ফেলার কথা বলে তাঁকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করেন রাহুল গাঁধী। ওই ঘটনায় সব স্তরেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তবে এখানেও শেষ নয়। দিন কয়েক আগে মনমোহনের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের অনুষ্ঠানেও অনুপস্থিত ছিলেন রাহুল। অনেকেই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই আচরণ আসলে অসৌজন্য। কংগ্রেসের একাধিক প্রবীণ নেতাও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী পদটি একটি রাজনৈতিক পদ। তাই প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনীতিটাও করতে হয় মনমোহনকে। সঙ্কটের মুহূর্তে তাঁকে ত্রাতা হিসেবে দেখতে চেয়েছে দেশ ও দল। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনমোহন নীরব থেকে দেশ এবং দলকে বার বার হতাশ করেছেন।

মূলত সেই কারণেই মনমোহনকে সরিয়ে বারবার ‘রাহুল লাও’ দাবি উঠেছে দলের নিচু তলা থেকে। ওই নেতার ব্যাখ্যা, “মনমোহনের প্রতি কংগ্রেসের অন্দরের এই অনাস্থাও সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরির একটা বড় কারণ।”

ওবামার ফোন

ফোনটা মনমোহন সিংহ পেলেন ইস্তফা দেওয়ার ঠিক পরেই। ও-পারের ব্যক্তি বললেন, “আপনার সঙ্গে প্রত্যেক দিন কাজের অভিজ্ঞতাটা খুব মিস করব। হাতে গোনা যে ক’জনকে এতটা শ্রদ্ধা করি, আপনি তাঁদের অন্যতম।” বারাক ওবামার গলায় স্পষ্টতই তখন আবেগ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, মনমোহনের প্রধানমন্ত্রিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। মনমোহন তাঁর স্বভাবসুলভ সৌজন্যের সঙ্গে উত্তর দেন, “শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ভিত শক্ত রাখা জরুরি। আমার বিশ্বাস, নরেন্দ্র মোদী সরকারও সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেষ্ট থাকবে।” ওবামার পরিবারের কুশল সংবাদ নেন মনমোহন। ভারতে আসার আমন্ত্রণও জানিয়ে রাখেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement