চাপে পড়ে উদার হল সিপিএম! রাজ্য কমিটিগুলিকেই এ বার থেকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে নিজেদের রাজ্যের পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ফলে, বন্ধ হতে চলেছে রাজ্যগুলির উপরে কেন্দ্রীয় নেতাদের খবরদারি। আর এই সংস্কারের প্রথম প্রভাব পড়তে চলেছে বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদ্যসমাপ্ত বৈঠকের এই সিদ্ধান্তে বিহারের সঙ্গে ওড়িশা বা তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলি অন্তত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন হলো। এত দিন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব তাঁদের এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সর্ম্পকে ওয়াকিবহাল থাকলেও ‘সর্বভারতীয় লাইন’ মেনে চলতে হতো। বিশেষত, নির্বাচনী বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম ছিল অত্যন্ত কঠোর। ফলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য কমিটিগুলি অন্য রকম কিছু মনে করলেও তাদের সিদ্ধান্ত কাজে লাগাতে পারত না। এমন নীতি যে বাস্তবসম্মত ছিল না, তা বুঝলেও কেন্দ্রীয় নেতারা এত দিন পুরনো ভাবনাতেই চলছিলেন। কিন্তু তাতে আখেরে যে দলের ক্ষতি হয়েছে, তা বুঝে এ বার কেন্দ্রীয় কমিটি রাজ্যগুলিকে নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে ছাড় দিচ্ছে।
এই নীতি গ্রহণের আগে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব চেয়ে বেশি আলোচিত রাজ্যের নাম বিহার। এই রাজ্যে সম্প্রতি ১০টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে জোট বেঁধে সাফল্য পেয়েছেন লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার। সেখানে সিপিএম, সিপিআই এবং সিপিআইএম (লিবারেশন) তিন বাম শক্তি মিলে একটি আসনও ঝুলিতে ভরতে পারেনি। বিহারের টাটকা এই উদাহরণ টেনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের একাংশ এ বার সরব ছিলেন রাজ্যগুলিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার দাবিতে। বিহারের সঙ্গে তামিলনাড়ুর নেতারাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা সব সময় বাস্তবসম্মত হয় না। তাঁদের যুক্তি, রাজ্য নেতারা সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক দলগুলির শক্তি সর্ম্পকে অনেকটাই ওয়াকিবহাল। এমনকী, সেখানকার জনগণের শ্রেণি চরিত্র সর্ম্পকেও তাদের ধারণা থাকে স্পষ্ট। এতটা স্পষ্ট ধারণা কেন্দ্রীয় নেতাদের থাকার কথা নয়। ফলে, সর্বভারতীয় চরিত্রকে একই চোখে দেখতে গিয়ে রাজ্যভিত্তিক কৌশল নির্ধারণকে এত দিন অবহেলা করে এসেছে সিপিএম। তার ফল, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে সংগঠন বৃদ্ধি তো দূর, শক্তি তলানিতে এসে ঠেকছে!
লোকসভা নির্বাচনের সময় কোনও আঞ্চলিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় যায়নি সিপিএম। সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল সিপিআই। বিহারে লোকসভায় জেডিইউ-এর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করে নিজেদের ভোটব্যাঙ্কে সামান্য বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছে তারা। সেখানে সিপিএম ‘একলা চলো’র নীতিতে আরও শক্তিক্ষয়ের রাস্তায় গিয়ে পড়েছে! কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ মনে করছেন, রাজ্যগুলিকে এই স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে দলের মধ্যে নতুন করে একটা পরীক্ষা শুরু হবে। এই সূত্র কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা অবশ্য আগামী দিনে বোঝা যাবে। তবে বিহার, ওড়িশার মতো রাজ্যগুলি যে এতে অনেকটাই নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থাকল না।
বিহারের সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “দল এ বার আমাদের জন্য দরজা খুলে দিল। তাতে আমরা প্রয়োজনে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে বোঝাপড়ায় অনেকটা খোলামেলা আলোচনা করতে পারব। আবার একই সঙ্গে পরিস্থিতির বিচারে আমরা বুঝে নিতে পারব, আরজেডি-জেডিইউ জোট আমাদের কতটা লাভবান করবে বা বাম দলগুলির বোঝাপড়া কতটা ক্ষতি করবে।” পার্টি কংগ্রেসের দিকে তাকিয়ে এমন নীতি গ্রহণ করে দলের রক্ষণশীলতার গণ্ডিকে ভেঙে নেতাদের একটা বড় অংশ পরোক্ষে প্রকাশ কারাটকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন বলেও মনে করছেন কিছু নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “এ বার আমরা বোধহয় হিন্দি বলয়ের ক্ষেত্রে পুরনো বস্তাপচা ধারণা ঝেড়ে ফেলতে পারলাম!”
তবে নতুন কৌশলেও দলের অন্দরে প্রশ্ন থাকছে, এর জেরে আবার এক এক রাজ্যে এক এক রকম সিদ্ধান্তের মাসুল দিতে হবে না তো?